ধানমন্ডি লেকের একটি রেস্তোরাঁয় মাদকসেবন ও চেয়ারে বসা নিয়ে ড. মালেকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আলভি ও তার বন্ধুদের সাথে কয়েকজনের বাগি¦তণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। তার পরদিন আলভি তার তিন বন্ধুর সাথে ধানমন্ডি লেকে একটি রেস্টুরেন্টে অবস্থান করছিলেন। এ সময় কয়েকজন তাদেরকে কৌশলে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। তারা আলভি ও তার বন্ধুদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরি ও চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আলভিকে মৃত ঘোষণা করেন। আলভির তিন বন্ধুও আহত হয়। আলভি ড. মালেকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ফটোগ্রাফার নুরুল ইসলাম নিজের নামে ফেসবুকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি তোলেন। ১৫ মে বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য নূরুলকে ৫০০ টাকা অগ্রিম দেয় একটি টিকটকার গ্রুপ। পরদিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডির শঙ্কর বাসস্ট্যান্ড থেকে নূরুল ও তার সহযোগী ইমনকে অটোরিকশায় তুলে জাফরাবাদ পুলপার এলাকার একটি স্কুলের কাছে নিয়ে যায়। হঠাৎ করে ১০ থেকে ১২ জন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত হামলা চালালে ইমন রিকশা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে গেলেও নূরুল ইসলামকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথা, ঘাড় ও হাতে আঘাত করে গুরুতর জখম করে ক্যামেরা ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পরে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় মঙ্গলবার পৃথক অভিযানে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। টিকটকের ভিডিও করার জন্য ডিএসএলআর ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা থেকে এই হত্যাকাণ্ড করেছে বলে স্বীকার করে আসামিরা।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাকিব ও একটি দোকানের কর্মচারী মমিন দুই বন্ধু চলতি মাসের ১২ তারিখ আরেক বন্ধু আলামিনকে নিয়ে এজিবি কলোনির কাঁচাবাজারে ৩৯০ টাকায় আম বিক্রি করে। তিন ভাগের একভাগ ১৩০ টাকা আলামিনকে দিলেও বাকি টাকা থেকে রাকিব ৮০ টাকা খরচ করে ফেলে। পরে রাকিব মমিনকে আম বিক্রির ১০০ টাকা দিলেও বাকি ৩০ টাকা দাবি করলে তাদের মধ্যে বাগি¦তণ্ডা হয়। পরের দিন ওই টাকা নিয়ে আবারো ঝামেলা হলে রাকিব আম কাটার ছুরি দিয়ে মমিনের গলায় আঘাত করে। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় মামলা হলে রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
শুধু এসব ঘটনাই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এখন হত্যা সাধারণ বিষয়ে রূপ নিয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন অন্যজনকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। তবে হত্যার ঘটনা ঢাকাতে দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত রাজধানীতে ১৩৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৭টি ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। বাকিগুলো ঘটেছে অরাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ পারিবারিক কলহ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক লেনদেন ও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এ ছাড়াও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি, দস্যুতার ঘটনা ২৮৩টি ও চুরির ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ২৮টি। তবে রাজধানীতে পারিবারিক কলহে মোট হত্যাকাণ্ডের ৪০ শতাংশের বেশি ঘটনা ঘটছে বলে জানা যায়।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে। এতে দেখা যায়, বছরের প্রথম চার মাসে এক হাজার ২৪৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এতে করে জানুয়ারিতে ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০টি, মার্চে ৩১৬টি ও এপ্রিলে ৩৩৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে ক্রাইম সিন ও এ জাতীয় সিরিয়াল দেখা, সামাজিক বন্ধন ও সহমর্মিতা কমে যাওয়া, একে অপরকে ছাড় দেয়ার প্রবণতা কমে যাওয়া, টেকনোলজিতে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকে পড়াসহ বিভিন্ন কারণ কাজ করছে। এসব কারণেই ভবিষ্যতে নৃশংসতা আরো বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে এবং সহাবস্থানের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তা হলেই নৃশংস ঘটনাগুলো কমে আসতে পারে। অন্যথায় মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেলে আরো নৃশংস হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, যখনই ছোট বা বড় কারণে বড় অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যায় তখন মনে করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে তা নিয়ন্ত্রেণ নেই। হত্যা, ছিনতাই, চুরি ও গুমের মতো অপরাধগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তরুণদের মধ্যে আমিত্বের প্রকাশ থেকে বেশি অপরাধ হচ্ছে। আধিপত্য বিস্তার বা ছোট কোনো কারণে হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এখানে কারণের চেয়ে অহমিকার প্রভাবটা বেশি লক্ষ করা যায়। অনেকের মধ্যেই ধারণা হচ্ছে, অপরাধ করলে এর বিচার নাও হতে পারে। তা ছাড়া গ্রেফতার করলেও সে ছাড়া পাবে। এই ধারণাগুলো বেশি অপরাধে প্রভাব ফেলছে। তা ছাড়া মব জাস্টিজের নামে এখন বেশি অপরাধ হচ্ছে। যেখানে হত্যা করলেও বিভিন্নভাবে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। তাই এই অপরাধ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
তিনি আরো বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক নৃশংসতা প্রতিরোধের জন্য বিচার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্র ও সমাজ এ কাজগুলোতে জোর দিলে নিজ থেকেই নৃশংস ঘটনাগুলো কমে আসবে। ঝগড়া, মারামারি, পারিবারিক কলহ, রাজনৈতিক, বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা। আগের সংগঠিত কোনো অপরাধের বিচার যদি দ্রুত সময়ে না হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়।