শিবিরের ঐতিহাসিক বিজয়

ডাকসুতে ২৮ পদের ২৩টিতেই জয় : ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এস এম ফরহাদ, এজিএস মহিউদ্দিন খান

হারুন ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Printed Edition
ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা
ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা |নয়া দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ইতিহাসে রেকর্ড করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থীরা। ইতিহাসে এবারই প্রথম ডাকসুর প্যানেলের দু-তৃতীয়াংশেরও বেশি পদে একই দলের প্রার্থীরা বিপুলসংখক ভোটে জয়ী হলেন। ডাকসুর ২৮ পদের ২৩টিতেই বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট। সেখানে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী সাদিক কায়েম। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী এস এম ফরহাদ নির্বাচিত হয়েছেন। সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে নির্বাচিত হয়েছেন লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন খান।

গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার পর ঢাবির সিনেট ভবনে আনুষ্ঠানিক ফলাফলে তাদের নাম ঘোষণা করেন ডাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।

ভিপি পদে ছাত্রশিবির প্যানেলের মো: আবু সাদিক (সাদিক কায়েম) পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পাঁচ হাজার ৭০৮ ভোট পেয়েছেন।

জিএস পদে ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন এস এম ফরহাদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল নেতা তানভীর বারী হামীম পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২৮৩ ভোট। এ ছাড়া প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘমল্লার বসু চার হাজার ৯৪৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

এজিএস পদেও বিজয়ী হন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের মুহা: মহিউদ্দীন খান। তিনি ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়েছেন।

এ ছাড়া আরো ২০ পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতেমা তাসনিম জুমা পেয়েছেন ১০ হাজার ৬৩১ ভোট। সাত হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে জয়ী হন ইকবাল হায়দার। আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে খান জসিম পেয়েছেন ৯ হাজার ৭০৬ ভোট। ছাত্র পরিবহন সম্পাদক হিসেবে লড়ে আসিফ আবদুল্লাহ পেয়েছেন ৯ হাজার ৬১ ভোট। সাত হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন আরমান হোসাইন। কমন রুম, রিডিং রুম ও কাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে ছালমা পেয়েছেন ৯ হাজার ৯২০ ভোট। ১১ হাজার ৭৪৭ ভোট পেয়ে মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক হন সাখাওয়াত জাকারিয়া। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে এম এম আল মিনহাজ পেয়েছেন সাত হাজার ৩৮ ভোট। এ ছাড়া ৯ হাজার ৩৪৪ ভোট পেয়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক পদে বিজয় ছিনিয়ে আনেন মাজহারুল ইসলাম। একই প্যানেল থেকে সদস্য হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন সাবিকুন্নাহার তামান্না (১০ হাজার ৪৮ ভোট), সর্বমিত্র (আট হাজার ৯৮৮ ভোট), আনাস ইবনে মুনির (পাঁচ হাজার ১৫ ভোট), ইমরান হোসেন (ছয় হাজার ২৫৬), তাজিনুর রহমান (পাঁচ হাজার ৬৯০), মেফতাহুল হোসেন আল মারুফ (পাঁচ হাজার ১৫), বেলাল হোসাইন অপু খান (চার হাজার ৮৬৫), রাইসুল ইসলাম (চার হাজার ৫৩৫), মো: শাহিনুর রহমান (চার হাজার ৩৯০), মোছা: আফসানা আক্তার (পাঁচ হাজার ৭৪৭) ও রায়হান উদ্দীন (পাঁচ হাজার ৮২ ভোট)।

প্যানেলের বাইরে বাকি পাঁচ পদে জয়ীরা হলেন- সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ। গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বী। সদস্য পদে হেমা চাকমা ও উম্মু উসউয়াতুন রাফিয়া।

ভোটের ব্যবধান : ডাকসুর শীর্ষ তিন পদে শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। তবে ডাকসুর অন্য পদগুলোয় ছাত্রদলের প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেননি।

সহসভাপতি (ভিপি) : ফলাফলে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস)- শীর্ষ এই তিন পদেই জিতেছে শিবিরের প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট।

ভিপি পদে ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে জিতেছেন শিবিরের প্রার্থী মো: আবু সাদিক কায়েম। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান। তিনি পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৭০৮ ভোট।

স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন তিন হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। তিন হাজার ৩৮৯ ভোট পেয়ে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা হয়েছেন চতুর্থ। আর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী আবদুল কাদের পঞ্চম হয়েছেন এক হাজার ১০৩ ভোট পেয়ে।

সাধারণ সম্পাদক (জিএস) : জিএস পদে শিবিরের প্রার্থী এস এম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জিতেছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম। তিনি পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২৮৩ ভোট।

চার হাজার ৯৪৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী চার হাজার ৪৪ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার দুই হাজার ১৩১ ভোট পেয়ে হয়েছেন পঞ্চম।

সহ সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) : এজিএস পদে শিবিরের প্রার্থী মুহা: মহিউদ্দীন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের তানভীর আল হাদি মায়েদ পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৬৪ ভোট।

স্বতন্ত্র প্রার্থী (গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা) তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী তিন হাজার আট ভোট পেয়ে আছেন তৃতীয় অবস্থানে। এক হাজার ৫১১ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন প্রতিরোধ পর্ষদের জাবির আহমেদ জুবেল। আর এক হাজার ১৩৭ ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন রনি।

অন্যান্য পদ : ডাকসুর ১২টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ৯টিতে জিতেছে শিবিরের প্যানেল। বাকি তিনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হলেন গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে সানজিদা আহমেদ তন্বী, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদে যুবাইর বিন নেছারী।

মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক : ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে শিবিরের প্যানেলের প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমা ১০ হাজার ৬৩১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আরিফুল ইসলাম পেয়েছেন দুই হাজার ৪৭০ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী নূমান আহমাদ চৌধুরী এক হাজার ৭৭৬ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে শিবিরের প্যানেলের ইকবাল হায়দার সাত হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে জিতেছেন। চার হাজার ২৭৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আহাদ বিন ইসলাম শোয়েব। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের মমিনুল ইসলাম তিন হাজার ২০০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক : কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯ হাজার ৯২০ ভোট পেয়ে শিবিরের প্যানেলের প্রার্থী উম্মে ছালমা জয়ী হয়েছেন। চার হাজার ৪৮২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের সুর্মী চাকমা। তৃতীয় হয়েছেন ছাত্রদলের প্রার্থী চেমন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা, তার ভোট দুই হাজার ৭০২।

আন্তর্জাতিক সম্পাদক : আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে শিবিরের প্যানেলের জসীমউদ্দিন খান ৯ হাজার ৭০৬ ভোট পেয়ে জিতেছেন। তিন হাজার ৯২২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের মোহাম্মদ সাকিব। আর তিন হাজার ২৩১ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন ছাত্রদলের মেহেদী হাসান।

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক : সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে সাত হাজার ৭৮২ ভোট পেয়ে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ। দুই হাজার ৭৪৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন শিবিরের প্রার্থী নুরুল ইসলাম। দুই হাজার ১৪৭ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন প্রতিরোধ পর্ষদের ফারিয়া মতিন (ইলা)।

গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক : গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বী। তার প্রাপ্ত ভোট ১১ হাজার ৭৭৮। তাকে সমর্থন জানিয়ে ছাত্রদলসহ কয়েকটি প্যানেল এই পদে প্রার্থী দেয়নি। তার সাথে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে শিবিরের প্রার্থীর। শিবিরের প্রার্থী মো: সাজ্জাদ হোসাইন খান সাত হাজার ১৮৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন।

ক্রীড়া সম্পাদক : ক্রীড়া সম্পাদক পদে শিবিরের প্রার্থী আরমান হোসেন সাত হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তিন হাজার ৮৩১ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী মো: আল-আমিন সরকার। তিন হাজার ৭৮৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় ছাত্রদলের চিমচিম্যা চাকমা। আর তিন হাজার ৪৩৮ ভোট নিয়ে চতুর্থ হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জহিন ফেরদৌস জামি।

ছাত্র পরিবহন সম্পাদক : ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ৯ হাজার ৬১ ভোট পেয়ে জিতেছেন শিবিরের প্রার্থী আসিফ আবদুল্লাহ। চার হাজার ৫০৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের রাফিজ খান। আর তিন হাজার ৩১২ ভোট পেয়ে তৃতীয় ছাত্রদলের মো: সাইফ উল্লাহ।

সমাজসেবা সম্পাদক : সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী (এ বি যুবায়ের) সাত হাজার ৬০৮ ভোট পেয়ে জিতেছেন। ছাত্রদলের প্রার্থী সৈয়দ ইমাম হাসান অনিক তিন হাজার ৯০৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। শিবিরের প্রার্থী শরীফুল ইসলাম দুই হাজার ৫৫৬ ভোট পেয়ে তৃতীয়। আর দুই হাজার ৯৯ ভোট পেয়ে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের মহির আলম হয়েছেন চতুর্থ।

ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক : ৯ হাজার ৩৪৪ ভোট পেয়ে ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে জিতেছেন শিবিরের প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। চার হাজার ১২৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা। আর তিন হাজার ৬১৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় ছাত্রদলের মোহাম্মদ আরকানুল ইসলাম।

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক : স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে সাত হাজার ৩৮ ভোট পেয়ে জিতেছেন শিবিরের প্রার্থী এম এম আল মিনহাজ। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন দুই হাজার ৯৬৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। আর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী সাব্বির আহমেদ দুই হাজার ৯৪৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক : মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে শিবিরের প্রার্থী মো: জাকারিয়া ১১ হাজার ৭৪৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আনিকা তাহসিনা তিন হাজার ৪২৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। তিন হাজার ৩৬৫ ভোট নিয়ে তৃতীয় হয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের নুসরাত জাহান নিসু।

সদস্যপদ : ডাকসুর ১৩টি সদস্যপদের মধ্যে ১১টিতেই জিতেছেন শিবিরের ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। তারা হলেন সাবিকুন নাহার তামান্না (১০ হাজার ৮৪ ভোট), সর্ব মিত্র চাকমা (আট হাজার ৯৮৮ ভোট), ইমরান হোসাইন (ছয় হাজার ২৫৬ ভোট), মোছা: আফসানা আক্তার (পাঁচ হাজার ৭৪৭ ভোট), তাজিনুর রহমান (পাঁচ হাজার ৬৯০ ভোট), রায়হান উদ্দীন (পাঁচ হাজার ৮২ ভোট), মো: মিফতাহুল হোসাইন আল-মারুফ (পাঁচ হাজার ১৫ ভোট), আনাস ইবনে মুনির (পাঁচ হাজার ১৫ ভোট), মো: বেলাল হোসেন অপু (চার হাজার ৮৬৫ ভোট), মো: রাইসুল ইসলাম (চার হাজার ৫৩৫ ভোট) ও মো: শাহিনুর রহমান (চার হাজার ৩৯০ ভোট)।

এ ছাড়া বামপন্থী প্রতিরোধ পর্ষদ থেকে সদস্যপদে চার হাজার ৯০৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন হেমা চাকমা। চার হাজার ২০৯ ভোট পেয়ে সদস্যপদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়া।

ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ : শিবিরের অভাবনীয় বিজয়ে নেপথ্যে

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন-২০২৫ এর ফলাফল বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এক অভাবনীয় এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে প্রায় অদৃশ্য থাকা ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ ছাত্রজোট’ এবারের নির্বাচনে শুধু জোরালোভাবে অংশগ্রহণই করেনি, বরং ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি), জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) সহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্যাম্পাসের ক্ষমতার ভারসাম্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এ বিজয়কে কেবল একটি ছাত্রসংগঠনের আকস্মিক উত্থানই নয়; বরং এটি সংগঠন, কৌশল, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা, ভোটারদের পরিবর্তনকামী মানসিকতা এবং সাম্প্রতিক জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফসল। কেন ও কিভাবে এই অভাবনীয় বিজয় সম্ভব হলো, সেই বিশ্লেষণই এখন ছাত্ররাজনীতির অন্দরমহল থেকে শুরু করে জাতীয় পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনের প্রেক্ষাপট : প্রত্যাশা ও নতুন বাস্তবতা

ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে বরাবরই জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি লিটমাস টেস্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে রাজনৈতিক হাওয়া বয়, তার ঢেউ প্রায়ই জাতীয় রাজনীতিতে আছড়ে পড়ে। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল দীর্ঘ ২৮ বছর পর, ২০১৯ সালে। এরপর নির্বাচন আয়োজনের দাবি উঠলেও নানা জটিলতায় স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছেন।

হিসাব কষলে দেখা যায় এবারের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ‘জুলাই আন্দোলন’ বা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ঠিক পরের বছর। এই গণ-অভ্যুত্থান দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিয়েছে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি, দখলদারিত্ব, গণরুম-গেস্টরুমের নির্যাতনমূলক সংস্কৃতি এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণা থেকে শিক্ষার্থীরা একটি বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল, এবারের নির্বাচন হবে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকারভিত্তিক রাজনীতির প্রতিফলন। এই আকাক্সক্ষার প্রেক্ষাপটেই শিবির-সমর্থিত জোটের উত্থান ক্যাম্পাসে একাধারে বিস্ময় এবং এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে।

বিজয়ের নেপথ্যে : শিবিরের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে একক কোনো কারণ নেই, বরং এটি ছিল বহুমুখী কৌশলের সফল বাস্তবায়ন। এর প্রধান দিকগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে।

সাংগঠনিক শক্তি ও সুদীর্ঘ প্রস্তুতি : অন্যান্য ছাত্রসংগঠন যখন প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল, ছাত্রশিবির তখন নীরবে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার কাজ চালিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসে তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি কম থাকলেও, তারা হল ও বিভাগভিত্তিক নেটওয়ার্কিং এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি থাকার কৌশল অবলম্বন করেছে।

এ ছাড়া নিরাপত্তাহীনতা, সেশনজট ও ক্রমবর্ধমান শিক্ষাব্যয়ের মতো মৌলিক সমস্যাগুলোকে তারা তাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রে রেখেছে। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যেখানে অন্য সংগঠনগুলো, বিশেষ করে বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বেশ পিছিয়ে ছিল, সেখানে শিবির স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কোচিং সেন্টার পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি কাজের সুফল পেয়েছে। নির্বাচনের বহু আগে থেকেই তাদের এই নীরব প্রস্তুতি এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভোটের মাঠে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

জুলাই আন্দোলনের সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ : ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিয়েছিল, তা ছিল মূলত প্রচলিত রাজনৈতিক বিরোধী। তারা প্রচলিত ধারার ছাত্রসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অতীত কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ ছিল। শিবির এ সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছে। তারা নিজেদেরকে সহিংসতা ও দখলদারিত্বের রাজনীতির বাইরের ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাদের প্রচারণায় বড় বড় রাজনৈতিক স্লোগানের চেয়ে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘পরিবর্তন’ ও ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস’- এ দু’টি বার্তা তরুণ ভোটারদের মনে গভীর আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়, বিশেষ করে যারা ‘জুলাই জেনারেশন’ হিসেবে পরিচিত।

প্রতিপক্ষের বিভেদ ও কৌশলগত ব্যর্থতা : শিবিরের বিজয়ের পেছনে তাদের নিজেদের শক্তির পাশাপাশি প্রতিপক্ষের দুর্বলতাও বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে ডাকসুতে প্রভাবশালী বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এবার অভ্যন্তরীন কোন্দলে জর্জরিত ছিল। তাদের বিভিন্ন উপদল একাধিক প্যানেলে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তাদের ভোটব্যাংক বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

অন্য দিকে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সেই ভাবমর্যাদাকে পুরোপুরি ভোটে রূপান্তরিত করতে পারেনি। তাদের প্রচারণায় সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বামপন্থী এবং প্রগতিশীল জোটগুলোর ক্ষেত্রে। বাম দলগুলো বরাবরই আদর্শিকভাবে ঋদ্ধ এবং আন্দোলনে অগ্রণী থাকলেও ভোটের রাজনীতিতে তাদের অনৈক্য আবারও প্রকট হয়ে উঠেছে। শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি-মেঘমল্লার বসুর নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল’ এবং অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ জোট আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় সমমনা ভোটগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই বিভাজনের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ নিয়েছে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করা ছাত্রশিবির।

ইস্যুভিত্তিক প্রচারণা ও পরিশীলিত কৌশল : এবারের নির্বাচনে শিবির তাদের চিরাচরিত রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়গুলোকে সামনে এনেছে। তারা ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস, মাদক ও র‌্যাগিংমুক্ত পরিবেশ, নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের ইশতেহারে আবাসন সঙ্কট সমাধানে সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা এবং লাইব্রেরি সুবিধা বৃদ্ধিসহ অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। ভোটারদের একটি বড় অংশ হয়তো তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে একমত নন, কিন্তু নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাসের এই বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতিকে তারা উপেক্ষা করতে পারেননি। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা, যাদের কাছে নিরাপদ পরিবেশই ছিল প্রধান দাবি, তারা ব্যাপকভাবে শিবিরের দিকে ঝুঁকেছে।

নির্বাচনের দিনেও তাদের কর্মীরা ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। ভোটারদের লাইনে আনা থেকে শুরু করে ভোটদান পর্যন্ত তাদের শান্ত ও সংগঠিত আচরণ ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্য দিকে কয়েকটি কেন্দ্রে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে উত্তেজনা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে, যা পরোক্ষভাবে শিবিরের পক্ষেই গেছে। তবে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিল জগন্নাথ হল, যেখানে সংখ্যালঘু ভোটাররা শিবিরকে প্রায় পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেখানে সাদিক কায়েম ১০টি ভোট পেয়েছেন। সেখানে ভিপি পদে ছাত্রদলের প্রার্থী ও জিএস পদে বামজোটের প্রার্থী মেঘমল্লার বসু বিপুল ভোটে জয়ী হন, যা ক্যাম্পাসের ভোটের মেরুকরণকেও স্পষ্ট করে।

ফলাফল ঘোষণার সাথে সাথেই ক্যাম্পাসে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়। ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর অভিযোগ তোলেন। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রশাসনকে ‘জামায়াত-ঘনিষ্ঠ’ ও শিবিরের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করা হয়।

ভবিষ্যৎ রাজনীতি : ডাকসুতে শিবিরের এই বিজয় কেবল ক্যাম্পাস রাজনীতিতেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও আলোড়ন তুলেছে। এটি প্রতিষ্ঠিত বড় দলগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা। তরুণ প্রজন্ম যদি তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে এমন বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজে ফেরে, তবে ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। আসন্ন জাহাঙ্গীরনগর (জাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাকসু) ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও এই ফলাফলের প্রভাব পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

ডানপন্থী মনা সংগঠন ডাকসুতে একচ্ছত্র ভাবে বিজয় আসায় শঙ্কা হিসেবে দেখছেন অনেকেই। যদিও বিজয়ের পর শিবিরসমর্থিত জোট একটি শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ডাকসু নির্বাচন ২০২৫-এর ফলাফল একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। এটি এক দিকে যেমন ছাত্রশিবিরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক দক্ষতার ফসল, তেমনই প্রতিপক্ষের কৌশলগত ব্যর্থতা এবং তরুণ প্রজন্মের পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি। এখন দেখার বিষয়, বিজয়ী শিবির কি ডাকসুকে একটি সত্যিকারের ছাত্রপ্রতিনিধি পরিষদে পরিণত করতে পারবে, নাকি এটিও পুরনো ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্তেই আটকে যাবে। এর উত্তর সময়ই দেবে, তবে এটুকু নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি এক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।

এ বিজয় ব্যক্তিগত নয়, শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত জয় : ভিপি সাদিক কায়েম

ডাকসু নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেছেন এ জয় কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি ‘জুলাই প্রজন্ম’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর সম্মিলিত জয়।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে কেউ হারেনি। এখানে জয়ী হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী, জয়ী হয়েছে জুলাইবিপ্লবের আকাক্সক্ষা, জয়ী হয়েছে শহীদদের স্বপ্ন।

সাদিক কায়েম বলেন, আমাদের এই বিজয় শহীদদের আত্মত্যাগের ফসল। আমরা স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ, আধিপত্যবিরোধী সংগ্রামের শহীদ এবং বিশেষভাবে স্মরণ করছি শহীদ আবরারকে, যিনি ছাত্ররাজনীতির সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারান। আল্লাহ যেন তাদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। তিনি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাকে এবং আমার সহযোদ্ধা এস এম ফরহাদ ও মহিউদ্দিন খানসহ পুরো প্যানেলকে যে আমানত দিয়েছেন, আমরা চেষ্টা করব সেই আমানতের যথাযথ হক আদায় করতে। ইনশা আল্লাহ, আমরা যে স্বপ্নের ক্যাম্পাস গড়ার অঙ্গীকার করেছি, তা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত থামব না।

সাদিক কায়েম আরো বলেন, আমি চাই না শিক্ষার্থীরা আমাকে শুধু ডাকসুর ভিপি হিসেবে দেখুক। আমি চাই তারা আমাকে ভাই, বন্ধু, সহপাঠী হিসেবেই জানুক। আমার আচরণ বা ভাষা যেন কোনোভাবেই অহঙ্কারের প্রকাশ না করে, সেটি আমি গুরুত্বসহকারে খেয়াল রাখব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা এমন একটি ক্যাম্পাস চাই, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য একটি উন্নত পরিবেশ পাবেন। গবেষণার সুযোগ থাকবে, আবাসন নিশ্চিত হবে, খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা থাকবে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য হবে নিরাপদ, সমানাধিকারের ক্যাম্পাস।

নারী শিক্ষার্থীদের অবদানকে বিশেষভাবে স্বীকার করে সাদিক বলেন, ডাকসু নির্বাচনের সফল আয়োজন এবং জুলাইবিপ্লবে আমাদের বোনদের সাহসী অংশগ্রহণ আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এই অর্জন তাদেরও সমানভাবে প্রাপ্য। তিনি বলেন, নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের কেউই প্রতিপক্ষ নন। তারা সবাই এখন আমাদের পরামর্শদাতা। আমরা মত-পথ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়েই কাজ করতে চাই।

সংবাদ সম্মেলনের শেষ অংশে দায়িত্ব পালনের সময় এক গণমাধ্যমকর্মীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সাদিক কায়েম বলেন, আমি তার পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাই। একই সাথে যেসব সাংবাদিক এই নির্বাচন কাভার করেছেন, তাদের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি বলেন, এই দায়িত্ব এক কঠিন পরীক্ষা। আমরা চাই, এই পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে। শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং একটি আধুনিক, মানবিক ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে আমরা সবার সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করছি।

শিবিরের দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫ ফলাফল-পরবর্তী দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর বিজয়ের মাধ্যমে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বিজয়ী হয়েছে। এ নির্বাচনে যারা বিভিন্ন প্যানেল থেকে ও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মহান আল্লাহ তায়ালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বের আমানত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যথাযথভাবে রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের এই ঐতিহাসিক বিজয় উপলক্ষে ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী নিম্নোক্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো- ১. শুকরিয়া আদায় করে দোয়া মাহফিল ও শব্বেদারি (নৈশ ইবাদত) বাস্তবায়ন। ২. শহীদদের কবর জিয়ারত এবং শহীদ পরিবার ও আহতদের সাথে সাক্ষাৎ।

কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে ছাত্রশিবিরের সকল মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয়, শহর ও জেলা শাখাকে উক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি কোনো ধরনের আনন্দ মিছিল, শোভাযাত্রা বা র‌্যালি আয়োজন করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি। রাব্বে কারিম, আমাদের সব তৎপরতা তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন। আমীন।