হাসিনার গণহত্যার বিচারের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আশাবাদ

ইকবাল মজুমদার তৌহিদ
Printed Edition

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই রায়কে ঘিরে উত্তেজনা ও প্রত্যাশা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

রাজনৈতিক নেতাদের মতামত : বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের দীর্ঘ আমলে বিচার বিভাগ ছিল বিচারহীনতার কালো চাদরে মোড়া। এবার লাইভ সম্প্রচারসহ যে স্বচ্ছ বিচার হয়েছে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যতেও এই স্বচ্ছতা অব্যাহত থাকলে কেউ আর রাজনৈতিক অভিযোগ তুলতে পারবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘একজন সাবেক আইজিপি রাজসাক্ষী হয়েছেন, আর বড় ধরনের গণহত্যার প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে উঠে এসেছে। পেনাল কোড অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রত্যাশিত।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব প্রহসনের বিচার হয়েছিল, এটি তার পুনরাবৃত্তি নয়। এটি প্রকৃত অর্থে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- ছাত্র, শিশু ও সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচারে চালানো গণহত্যার বিচার। তাই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়াই প্রত্যাশিত।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের যে তিন মূল দাবি- বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন- তার প্রথমটির বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। সাক্ষ্য-প্রমাণ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, ওই সময়ে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। জাতি সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রত্যাশা করে।’

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সরকার যথেষ্ট সময় নিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। কোনো পক্ষই বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। সুতরাং আদালত যেটি উপযুক্ত মনে করবেন, সেটিই দেবেন- এটাই স্বাভাবিক।’

বাম জোটের নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচার অব্যাহত থাকবে। এটি দাবি ছিল জনগণের এবং এই দাবি পূরণ হতে হবে।’

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে বিচার পরিচালনা করেছে। দেশবাসী গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট নেতাদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করে।’

ছাত্রসমাজের প্রতিক্রিয়া : ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম বলেন, ‘হাসিনা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বর, সাঈদীর রায়ের পর গণহত্যা এবং সর্বশেষ জুলাই গণহত্যা চালিয়েছে। প্রতিটি হত্যাযজ্ঞের বিচার হতে হবে। এই বিচারে আমরা সর্বোচ্চ সাজার প্রত্যাশা করছি।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্মসদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আসামিরা যে গণহত্যা পরিচালনা করেছে, তার উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই সর্বোচ্চ হওয়া উচিত।’

বিচারপ্রক্রিয়া : সময়রেখা ও প্রমাণ

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়। পুনর্গঠনের পর প্রথম বিবিধ মামলাটি (মিসকেস) দায়ের হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

গত বছরের ১৭ অক্টোবর প্রথম বিচারকাজ শুরু হয় এবং সেদিনই জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। শুরুতে শেখ হাসিনা একমাত্র আসামি ছিলেন। পরে ২০২৫ সালের ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রসিকিউশন পাঁচটি অভিযোগ আনে। তদন্ত প্রতিবেদন ছিল আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে- ২,০১৮ পৃষ্ঠা তথ্যসূত্র; ৪,০০৫ পৃষ্ঠা জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণ; ২,৭২৪ পৃষ্ঠা শহীদ তালিকা।

২০২৫ সালের ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে। এরপর ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন হয়। পরবর্তীতে সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন এবং ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। তিনি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দেন।

২৩ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল সমাপনী যুক্তিতে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন। এরপর চিফ প্রসিকিউটরও একই দাবি জানান।

রায়কে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা : পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকাসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন, বিশেষ টিম প্রস্তুত রাখা, সংবেদনশীল এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তল্লাশি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। উসকানি, ভাঙচুর বা নাশকতার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’