আহমদ মতিউর রহমান
প্রলয় আর সৌন্দর্যের রূপকার বলা হয় লাজলো ক্রাসনাহোরকাইকে। তিনি ২০২৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, ‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও শিল্পের শক্তি দেখানো তার প্রভাবশালী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্মের জন্য’ এ বছর তিনি সাহিত্যে নোবেল পেলেন। হাঙ্গেরির লেখক লাজলো ক্রাসনাহোরকাই ডিস্টোপিয়ান ও বিষণœতাময় উপন্যাসগুলোর জন্য খ্যাত। বলা হয়ে থাকে তার ভাষা বেশ কাঠিন্যে মোড়া। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে সাটানট্যাঙ্গো, দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স। এগুলো পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি ২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পেয়েছিলেন, প্রথম হাঙ্গেরির লেখক যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ২০১৯ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার জেতেন। এরপর এলো নোবেল। ২০০২ সালে হাঙ্গেরির আরেক লেখক ইমরে কার্তেজ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
ক্রাসনাহোরকাই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে হাঙ্গেরি সরকারের নীতির তীব্র নিন্দা করেছেন। এ থেকে ধারণা করা যায় তিনি যুদ্ধবিরোধী, সেই সাথে সোভিয়েত তথা বর্তমান রাশিয়ার বিরোধী। তবে তার দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ঘোর রুশ সমর্থক। ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত জামানায় হাঙ্গেরিতে আগ্রাসন চালায় তৎকালীন কমিউনিস্ট শাসকরা। বহু লোক প্রাণ হারায়। সেই স্মৃতি দগদগে অনেকের মনে। লাজলো সেই চেতনা লালন করেন। অরবানের ‘অভ্যন্তরীণ স্লাভিক বিষয়’ হিসেবে সঙ্ঘাতের চিত্র তুলে ধরাকে নৈতিকভাবে অপ্রতিরোধ্য এবং ঐতিহাসিকভাবে অসংলগ্ন বলে বর্ণনা করেছেন লাজলো। কারণ হাঙ্গেরির অতীতে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে এটি অসংলগ্ন ছিল। ক্রাসনাহোরকাই যুক্তি দিয়েছিলেন যে আগ্রাসনের মুখে নিরপেক্ষতা জড়িত থাকার সমান এবং অরবান সরকারের যুক্তিকে একধরনের মানসিক অস্বীকৃতির সাথে তুলনা করেছেন তিনি। তিনি শাসনব্যবস্থাকে ‘একটি মানসিক বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যা একটি নিয়তিবাদী ও আত্মধ্বংসাত্মক যুক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত, যা তার ভাষায়, মাকে বাঁচানোর জন্য নিজের সন্তানের মৃত্যুকে গ্রহণ করে, যার ফলে উভয়েরই মৃত্যু হয়। সাহিত্যের সাথে ও নোবেল পুরস্কারের সাথে রাজনীতি জড়িত। ফলে এসব বিষয় আলোচনায় আসছে।
ক্রাসনাহোরকাই ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি হাঙ্গেরির গিউলায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গিওর্গি ক্রাসনাহোরকাই ছিলেন একজন আইনজীবী এবং তার মা জুলিয়া প্যালিঙ্কাস একজন সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসক। তার বাবা তার ইহুদি বংশোদ্ভূত পরিচয় গোপন রেখেছিলেন, কেবল ক্রাসনাহোরকাই যখন ১১ বছর বয়স হয় তখনই তা প্রকাশ করেন। তিনি যে ইহুদি ১১ বছর পর্যন্ত তা জানতেন না। ১৯৭২ সালে ক্রাসনাহোরকাই এরকেল ফেরেঙ্ক হাইস্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন, যেখানে তিনি ল্যাটিন ভাষায় বিশেষজ্ঞ হন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি জোসেফ আত্তিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে সেজেদ বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বুদাপেস্টের ইওটভোস লোরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইএলটিই) আইন অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ইএলটিই মানবিক অনুষদে হাঙ্গেরীয় ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট শাসন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর লেখক ও সাংবাদিক সান্দোর মারাই (১৯০০-৮৯) এর কাজ এবং অভিজ্ঞতার ওপর তার থিসিস ছিল সাহিত্যের ছাত্র থাকাকালীন, ক্রাসনাহোরকাই প্রকাশনা সংস্থা গন্ডোলাত কোনিভকিয়াডোতে কাজ করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর থেকে ক্রাসনাহোরকাই নিজেকে একজন স্বাধীন লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৫ সালে, তার প্রথম উপন্যাস ‘সাতানটাঙ্গো’ সাফল্য অর্জন করে এবং তিনি তাৎক্ষণিকভাবে হাঙ্গেরীয় সাহিত্য জীবনের অগ্রভাগে চলে আসেন। এটি ২০১৩ সালে ইংরেজিতে সেরা অনূদিত বইয়ের পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো কমিউনিস্ট হাঙ্গেরির বাইরে ভ্রমণ করেন, একটি ফেলোশিপের প্রাপক হিসেবে পশ্চিম বার্লিনে এক বছর কাটিয়েছেন। সোভিয়েত ব্লকের পতনের পর থেকে, তিনি বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছেন। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো তিনি পূর্ব এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য সময় কাটাতে সক্ষম হন। তিনি মঙ্গোলিয়া এবং চীনে তার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ‘The Prisoner of Urga and Destruction and Sorrow Beneath the Heavens’ রচনা করেন। তিনি বহুবার চীন সফর করেছেন।
জার্মানির বার্লিনে বেশ কয়েক বছর বসবাসের পর, যেখানে তিনি বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটিতে ছয় মাস এস ফিশার অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। ক্রাসনাহোরকাই বর্তমানে হাঙ্গেরির ‘সেজেন্টলাসজলো পাহাড়ে এক নির্জনবাসী হিসেবে’ বসবাস করছেন।
১১টি উপন্যাস ও ছয়টি নভেলাসহ আরো বেশ কিছু বই রয়েছে। লাজলোর লেখার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমসাময়িক তাকে ধারণ করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উচ্চকিত করা। আছে সমাজতন্ত্রের পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে অনিশ্চয়তা ও নিরাশার কথা। সাতানটাঙ্গো হাঙ্গেরির সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। লাসলোর ব্রেকথ্রু উপন্যাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই বইটি। তার দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য মেলানকোলি অব রেজিসট্যান্স (১৯৮৯ সালে প্রকাশিত, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৮)। লাজলো দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলাতে জন্মগ্রহণ করেন। জিউলার মতোই একটি প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল হলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রথম উপন্যাস সাতানটাঙ্গোর (১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত) প্রেক্ষাপট। এই উপন্যাসে উঠে এসেছে হাঙ্গেরির একটি গ্রামীণ পরিত্যক্ত সমবায় খামারে বাস করা দরিদ্র কিছু মানুষের কথা। যারা সমাজতন্ত্রের পতনের সময়কাল বা আগ মুহূর্তে যারা অনিশ্চয়তা ও নিরাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তাদের কথা।
১৯৯৩ সালে, তার উপন্যাস ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’ বছরের সেরা সাহিত্যকর্মের জন্য জার্মান বেস্টেনলিস্ট-পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি বার্লিনে উইসেনশ্যাফটস্কোলগের অতিথি ছিলেন। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ উপন্যাসটি সম্পন্ন করার সময়, তিনি ইউরোপজুড়ে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কাজটি সম্পন্ন করতে ব্যাপক সহায়তা করেছিলেন; ক্রাসনাহোরকাই কিছু সময়ের জন্য গিন্সবার্গের নিউ ইয়র্ক অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন এবং তিনি বইটিকে জীবন্ত করার ক্ষেত্রে কবির বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শকে মূল্যবান বলে বর্ণনা করেছিলেন।
১৯৯৬, ২০০০ এবং ২০০৫ সালে তিনি কিয়োটোতে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। দূরপ্রাচ্যের নান্দনিকতা এবং সাহিত্য তত্ত্বের সাথে তার যোগাযোগের ফলে তার লেখার ধরনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে এবং বিষয়বস্তু প্রয়োগ করা হয়। তিনি প্রায়ই জার্মানি এবং হাঙ্গেরিতে ফিরে আসেন, তবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, গ্রিস এবং জাপানসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে বিভিন্ন সময় কাটিয়েছেন, তার উপন্যাস ‘সেইওবো দিয়ার বিলো’-এর জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতে, যা ২০১৪ সালে সেরা অনূদিত বইয়ের পুরস্কার জিতেছিলেন।
১৯৮৫ সালের শুরুতে পরিচালক এবং লেখকের বন্ধু বেলায় প্রায় একচেটিয়াভাবে লাজলোর কাজের ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে স্যাটানটাঙ্গো এবং ওয়ার্কমিস্টার হারমোনিজ। ক্রাসনাহোরকাই বলেছিলেন, ২০১১ সালের দ্য তুরিন হর্স চলচ্চিত্রটি তাদের শেষ সহযোগিতা হবে। ক্রাসনাহোরকাই শিল্পী ম্যাক্স নিউম্যানের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে চিত্রিত উপন্যাস চেজিং হোমার (২০২১), যার সাথে রয়েছে জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পী সিলভেসটার মিক্লোসের একটি মৌলিক পারকাশন স্কোর। ২০২০ সালে, ‘আকর্ষণীয় গল্প বলার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির’ জন্য তাকে মিনস্কে বোর্ট্রান্ড পুরস্কার দেয়া হয়।
ক্রাসনাহোরকাই সমালোচকদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক প্রশংসা পেয়েছেন। আমেরিকান সমালোচক সুসান সোন্ট্যাগ তাকে ‘সমসাময়িক হাঙ্গেরিয়ান অলৌকিক-উন্মোচনের মাস্টার যিনি গোগোল এবং মেলভিলের সাথে তুলনা করতে অনুপ্রাণিত করেন’ বলে বর্ণনা করেছেন। Susan Sontag described him as "the contemporary Hungarian master of apocalypse who inspires comparison with Gogol and Melville"- নকোলাই গোগোল ইউক্রেনের বংশোদ্ভূত ও মেলভিল মবিডিক উপন্যাসের জন্য খ্যাতিমান আমেরিকান লেখক। ডব্লিউজি সেবাল্ড মন্তব্য করেছেন, ‘ক্রাসনাহোরকাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সর্বজনীনতা গোগোলের ডেড সোলসের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সমসাময়িক লেখার সমস্ত ছোটখাটো উদ্বেগকে ছাড়িয়ে যায়।’
ক্রাসনাহোরকাই তার জটিল ও গভীর ভাবনাপ্রসূত উপন্যাসগুলোর জন্য পরিচিত। তার লেখাগুলো প্রায়ই উত্তর-আধুনিক হিসেবে চিহ্নিত হয়, যেখানে তিনি দুঃস্বপ্নলোক ও বিষণœ মানব অভিজ্ঞতার নানা দিক অনুসন্ধান করেছেন।
ক্রাসনাহোরকাই এক অসাধারণ সাহিত্য ভুবনের স্রষ্টা, যা তাকে হাঙ্গেরির অন্যতম প্রধান লেখক এবং নোবেল পুরস্কারের দীর্ঘদিনের প্রার্থী করে তুলেছিল। তার গল্পগুলো গঠিত হয় একক এবং অবিচ্ছিন্ন বাক্যে, যা কখনো নমনীয়ভাবে জটিল দার্শনিক চিন্তার দিকে মোড় নেয়, আবার কখনো রসিকতায় ভরে ওঠে। তার বিশ্বাস, ভালোবাসার মতো অভিজ্ঞতা, যা প্রকাশ করতে সময় ও সাহস লাগে তা সংক্ষিপ্ত বাক্যে ধরা যায় না।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রারম্ভিক জীবন কেটেছে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। পুলিশ তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছিল। তার প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো, যেমন- ‘সাটানটাঙ্গো’ ও ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’ সেই দমবন্ধ করা আবহই তুলে ধরে।
ইউরোপের আইরন কার্টেনের পতনের পর তার লেখায় আসতে থাকে এক ধরনের হালকা স্বচ্ছতা, যা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ উপন্যাসে, যেখানে তিনি গভীরভাবে যুক্ত হয়েছেন এশীয় শিল্প ও দর্শনের সঙ্গে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ভাবনায়।
তার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হারশট০৭৭৬৯’-এ তিনি এক দিকে জোহান সেবাস্টিয়ান বাখকে, আরেক দিকে জার্মান নব্য নাৎসিবাদকে পাশাপাশি স্থাপন করেছেন। আর দ্য ইয়েল রিভিউ এ তার এ সদ্য প্রকাশিত গল্প ‘এন অ্যাঞ্জেল পাসড অ্যাবভ আস’কে তুলনা করেছে ইউক্রেন যুদ্ধের কাদামাখা ট্রেঞ্চের বাস্তবতার সাথে প্রযুক্তিনির্ভর বৈশ্বিকীকরণের মায়াময় প্রতিশ্রুতিগুলোর। যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের লেখক হিসেবে তিনি বিশ্বাঙ্গনে স্থান করে নেবেন- এটি বলা যায়।



