সাক্ষাৎকার : ড. মাহবুবুল হক

ঐক্য ভেঙে গেলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition

মালয়েশিয়ার সুলতান জয়নাল আবিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুষদের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মাহবুবুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতিতে ঐকমত্যের সমস্যাটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া উচিত। ফ্যাসিবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিকশক্তির মধ্যে তো নোট অব ডিসেন্ট, মতভেদ, মতভিন্নতা থাকতে পারে। এই ভিন্নতায় এখনো সমঝোতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বেগম খালেদা জিয়া এখনো জীবিত আছেন। ওনার সাথে আলোচনা করলে মনে হয় না এ রকম বিষয়গুলোর সমাধান অসম্ভব।

নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মাহবুবুল হক এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশের বাইরে লাখ লাখ প্রবাসীর মতো আমরা এখনো আশাবাদী যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই যারা করেছেন, তাদের মধ্যে যে দৃঢ়তা সেটি অটুট থাকবে। এই দৃঢ়তা যেন ভেঙে না যায়, ভেঙে গেলে তা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে।

অধ্যাপক মাহবুবুল বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের সাথে সার্বভৌমত্ব জড়িত। একটা রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে হুমকির মধ্যে রাখছে। যারা এ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে তাদেরকে তারা প্রতিপালন করছে। এখন লড়াইরত মানুষের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐক্য না থাকে দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতি বা জুলাই শহীদের প্রতি যদি শ্রদ্ধা না থাকে তাহলে তা ব্যাপক আশাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই আশা ভঙ্গ হবে না। যে রাজনৈতিক বিরোধ তা এখনো মেটানো সম্ভব। নির্বাচন হবে কিন্তু আমাদের জোর দেয়া উচিত ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে। নির্বাচনে যাকে ভোট দেবে মানুষ সে দল ক্ষমতায় যাবে, যে যাবে না তাকে পরাজয়ের মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। এই মানসিকতা না রাখলে আওয়ামী লীগের সাথে আপনার পার্থক্য থাকল কোথায়।

নয়া দিগন্ত : রাজনীতি কি পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে চলে যাচ্ছে?

ড. মাহবুবুল হক : পয়েন্ট অব নো রিটার্ন বিএনপি-জামায়াত না আওয়ামী লীগ ভার্সেস আদারস। আওয়ামী লীগ ভার্সেস আদারস তো পয়েন্ট অব নো রিটার্ন হওয়াই উচিত। কারণ আওয়ামী লীগের সাথে কিসের ঐক্য হবে। যারা দেশের সার্বভৌমত্বকে বিলীন করে দিয়েছে, যারা এখন আগুন সন্ত্রাস করছে, তাদের সাথে তো সমঝোতার কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। হ্যাঁ, এই যে গণ-অভ্যুত্থানের যে শক্তি আছে এই শক্তির মধ্যে কিন্তু দিনের শেষে একটা ঐক্য লাগবেই লাগবে। ঐক্য ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো দানবশক্তিকে মোকাবেলা করা যাবে না। দানবের পাশে রয়েছে ভারত। এই জায়গায় যদি আমাদের ঐকমত্য না থাকে তাহলে তারা ফের এলে আমাদের কারো অস্তিত্ব রাখবে? এই বোধটা যদি যারা গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি তাদের মধ্যে না হয়, বুঝলাম কেউ না কেউ তো ক্ষমতায় যেতেই হবে; কিন্তু তারপর ফের তাদের আস্ফালন হলে যারা এখন আগুন সন্ত্রাস করছে এটা তো আরো বাড়বে। মাত্রা তো আরো ভয়ঙ্কর পর্যায়ে যাবে। ওদের মোকাবেলা করার জন্যে আমাদের কোনো জাতীয় ঐকমত্য আছে? তা নেই। তার মধ্যে গণভোট আগে হবে না পরে হবে এরকম একটা বিতর্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই বিতর্ক খামাকা তা বলছি না। এই বিতর্কের গুরুত্ব আছে; কিন্তু এই বিতর্কের চেয়ে আরো বড় বিতর্ক হচ্ছে ফ্যাসিবাদীরা আবার আসছে। এটা হবে আরো বড় বিপদ।

নয়া দিগন্ত : কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বলা হচ্ছে- আপনাদের কাণ্ডারি ভারতে চলে গেছে, আপনারা অসহায় বোধ করবেন না। আপনাদের পাশে বিএনপি আছে।

ড. মাহবুবুল হক : এগুলো একধরনের পপুলার টক। কিন্তু এ রকম পপুলার টক কি বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের পক্ষে মানায়? বিএনপির দাবি অনুযায়ী এতগুলো মানুষ প্রাণ দিয়েছে ষোল বছর বা গণ-অভ্যুত্থানের সময়, তাদের মানুষ হতাহত হয়েছে বেশি দাবি অনুযায়ী। তাহলে কি শহীদের সাথে বেঈমানি করা হয় না।

নয়া দিগন্ত : আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোয় প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন বাড়ছে

ড. মাহবুবুল হক : যখন আমরা ছাত্ররাজনীতি করেছি ’৯৫ সালে বাংলাদেশে তখন আমরা এসব দেখেছি। তাদের এই বর্বরতা। সরকারি কর্মচারী, জয়েন্ট সেক্রেটারি, সচিবালয় থেকে বের হয়ে আজিমপুরে বাসায় যাচ্ছিলেন, তাকে দিগম্বর করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায়। ছাত্রলীগের সেই কর্মীর নামই হয়ে গিয়েছিল দিগম্বর আলম। মানুষের সাথে এদের যে বর্বরতা। ’৯৫-৯৬ সালে ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এরা যা করেছে, সেই সময় তারা আমলাতান্ত্রিক ক্যু করেছে, এখন তো তারা আরো বেশি বলীয়ান। অর্থ, বিত্ত অনেক কিছু আছে তাদের। ভারত ’৯৫ সালে তাদের সাথে বর্তমান সম্পর্কের পর্যায়ে ছিল না। এখন ভারত তাদের সরাসরি সমর্থন করছে, অজিত দোভালের সাথে আমাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠক হচ্ছে...

নয়া দিগন্ত : ভারতের বিহারে তো বিজেপি নির্বাচনে জয় পেল...

ড. মাহবুবুল হক : বিহার ভারতের অন্যতম মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে শেষপর্যন্ত হিন্দুত্ববাদেই আস্থা দেখা গেল। ভারতে হিন্দুত্ববাদ বা বাংলাদেশে যারা হিন্দুত্ববাদের পলিটিক্সটা করে তাদের সাথে সহাবস্থান, আলোচনা, সমঝোতায় আপনি যদি যান তাহলে রাজনীতিটা আর থাকল না। জুলাই আন্দোলনে শহীদের সাথে এক-দেড় বছরের মধ্যে বেঈমানি হয়ে যাবে যদি আওয়ামী লীগের সাথে ভোটের রাজনীতির জন্য সমঝোতা কোনো দলকে করতে হয়।

নয়া দিগন্ত : তাহলে ভোটের রাজনীতিতে তো অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে?

ড. মাহবুবুল হক : তা তো নিশ্চয়। ডেফিনিটলি ’৭১ আমাদের জীবন ও রাজনীতিতে একটা মাইলস্টোন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের কথা বলে জাতির ভেতরে যে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে সেটি সবাই জানে। তো ২৪-ও একটা মাইলস্টোন। এ মাইলস্টোন হচ্ছে ফ্যাসিবাদের সাথে কোনো সমঝোতা নয়। তাদের রাজনীতির যেমন সুযোগ নেই, তাদের বিচার সম্পন্ন হবেই, এ বিচার বাস্তবায়ন হবে। এইটাই তো হওয়া উচিত স্পিরিটটা, তাই না।

নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় তরুণরা ফের রাস্তায় নেমে আসার কথা বলছেন...

ড. মাহবুবুল হক : তাই তো হওয়া উচিত। সত্তরের দশকে আওয়ামী লীগ একটা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। তারপর ’৭৩ ও ’৭৫-এর দিকটি লক্ষ করেন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করল। আওয়ামী লীগের নৃশংসতার সামনে তারা হয় টিকতে পারেনি। এখনো যদি আবার ফ্যাসিবাদ ফিরে আসে দেশে তাহলে তো যারা জুলাইযোদ্ধা রয়েছে, আহত হয়ে হাজার হাজার জুলাইযোদ্ধা রয়েছে আওয়ামী লীগ তাদের ওপর সবার আগে আঘাত হানবে। তাদের কথা হচ্ছে- কিসের জুলাই। সাতক্ষীরাতে জুলাই স্তম্ভ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এগুলো কিসের লক্ষণ?

নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশে তো গণভোট আগেও হয়েছে, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সময় গণভোট হয়েছে... এখন বিএনপির অনেক নেতা শঙ্কা প্রকাশ করছেন গণভোটে ‘না’ যদি জেতে তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।

ড. মাহবুবুল হক : এগুলো একধরনের জুজুর ভয়। আওয়ামী লীগ যেমন ভয় দেখাতো মৌলবাদ আসবে, জুজুর ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়? ঐকমত্যের সমস্যাটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া উচিত। ফ্যাসিবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে তো নোট অব ডিসেন্ট, মতভেদ, মতভিন্নতা থাকতে পারে। এই ভিন্নতায় এখনো সমঝোতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বেগম খালেদা জিয়া এখনো জীবিত আছেন। ওনার সাথে আলোচনা করলে মনে হয় না এ রকম বিষয়গুলোর সমাধান অসম্ভব; কিন্তু খালেদা জিয়ার দলের লোকেরা কী বলে সকাল-বিকেল, দুপুরবেলা বলে একটা, রাতে আরেকরকম। পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি কী বলল সেগুলো তো রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য খুব একটা সহায়ক নয়।

নয়া দিগন্ত : প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিভাবে দেখছেন?

ড. মাহবুবুল হক : আমরা এখনো আশাবাদী যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই যারা করেছেন, তাদের মধ্যে যে দৃঢ়তা সেটি যেন অটুট থাকে। এই দৃঢ়তা যেন ভেঙে না যায়, ভেঙে গেলে তা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে। কারণ ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের সাথে সার্বভৌমত্ব জড়িত। কারণ একটা রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে রাখছে। যারা এ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে তাদেরকে তারা প্রতিপালন করছে। এখন লড়াইরত মানুষের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐক্য না থাকে দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতি বা জুলাই শহীদের প্রতি যদি শ্রদ্ধা না থাকে তাহলে তা ব্যাপক আশাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই আশা ভঙ্গ হবে না। যে রাজনৈতিক বিরোধ তা এখনো মেটানো সম্ভব। নির্বাচন হবে; কিন্তু আমাদের জোর দেয়া উচিত ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে। নির্বাচনে যাকে ভোট দেবে মানুষ সে দল ক্ষমতায় যাবে, যে যাবে না তাকে পরাজয়ের মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। এই মানসিকতা না রাখলে আওয়ামী লীগের সাথে আপনার পার্থক্য থাকল কোথায়।

নয়া দিগন্ত : প্রবাসী হিসেবে তো এবার ভোট দেয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন...

ড. মাহবুবুল হক : মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস দেখলাম প্রচারণা শুরু করেছে। তারা মতবিনিময়ের আয়োজন করছে। গত ২২ বছর ধরে দেশের বাইরে কর্মরত আছি। ইন্দোনেশিয়ায় দেখেছি ২০০৩ সালে ওদের প্রবাসীরা ভোট দিচ্ছে দূতাবাসে গিয়ে। আমরা পারতাম না, এতিমের মতো মনে হতো। দেশের ব্যাপারে আমাদের কন্ট্রিবিউশন আছে; কিন্তু কোনো বক্তব্য নেই। এখনো তো অনলাইন, পোস্টাল অনেকগুলো সিস্টেমে ভোট হয়। দূতাবাসে গিয়ে ভোট দিতে হবে বা বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এমন নয়। যেখানে ব্যাংক লুট করে ফ্যাসিবাদীরা নিয়ে গেছে, প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ৩১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ হয়েছে যেটি হাসিনা ১৩ বিলিয়নে নামিয়েছিল। তো বাংলাদেশের দূতাবাস মালয়েশিয়ার কয়েকটি রাজ্যে মতবিনিময় করেছে এটা ভেরিগুড ইনেশিয়েটিভ। প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে দেশের বাইরে থাকলেও প্রবাসীদের একটা জায়গা রয়েছে দেশের ব্যাপারে একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার। রাজনৈতিক প্রতিফলনের মাধ্যমে ভোট দিয়ে সে প্রথমবারের মতো একটা অবদান রাখার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এটা তো আগে ছিল না। ভোট দিতে পারলে এটা হবে এক বিরাট অর্জন। অন্যান্য দেশের প্রবাসী বন্ধুদের সাথে আমাদের এসব নিয়ে কথা হয়। সরাসরি ভোট দিতে পারলে প্রবাসীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিষোদগার কমে যাবে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞা চলে আসবে।