পাবনার ১৫টি বিল থেকে অবাধে শামুক নিধন

জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয়ের শঙ্কা, উপেক্ষিত পরিবেশ সুরক্ষা

শীত মৌসুমে পানি কমতে শুরু করলে বিলপাড়ের বহু মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে শামুক আহরণে নেমে পড়েন। হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে শামুকের চাহিদা বেশি হওয়ায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির ধারা আরো বেড়েছে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া শামুক সংগ্রহ জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে, এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।

এসএম আলাউদ্দিন, পাবনা
Printed Edition
চলনবিল থেকে প্রতিদিন শামুক নিধন করে বিক্রি করা হচ্ছে
চলনবিল থেকে প্রতিদিন শামুক নিধন করে বিক্রি করা হচ্ছে |নয়া দিগন্ত

পাবনার বৃহত্তর চলনবিলসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কমপক্ষে ১০-১৫টি বিল ও খালজুড়ে এখন চলছে অবাধে শামুক নিধন। শীত মৌসুমে পানি কমতে শুরু করলে বিলপাড়ের বহু মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে শামুক আহরণে নেমে পড়েন। হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে শামুকের চাহিদা বেশি হওয়ায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির ধারা আরো বেড়েছে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া শামুক সংগ্রহ জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে, এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।

চাটমোহরের চলনবিল, সাঁথিয়ার মুক্তার বিল, গাংভাঙ্গা, গজারিয়া, বেড়া উপজেলার জোরদহ বিল, ধলাই, ট্যাংরাগাড়ি, সুজানগরের গাজনার বিলসহ অন্তত ১৫টি বিল থেকে প্রতিদিন শিকারীরা হাজার হাজার মণ শামুক সংগ্রহ করছেন। পাইকাররা সেগুলো বস্তায় ভরে ট্রাকে করে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করেন। শামুকের কেজিপ্রতি দাম ৫ থেকে ৭ টাকা। জীবিকার তাগিদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই নৌকা নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মই জাল, হেসি জাল বা হাত দিয়ে শামুক কুড়াচ্ছেন। অধিকাংশেরই ধারণা নেই যে শামুক শিকার বা বিপণন নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন রয়েছে।

জীবিকানির্ভরতা যতই শক্তিশালী হোক, এই আন্তঃনির্ভর জলজ প্রাণীটির নির্বিচার নিধন স্থানীয় পরিবেশে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে তা স্পষ্ট। শামুক জলের তলদেশের ময়লা খেয়ে পানি স্বচ্ছ রাখে, জলজ জীবকে বাঁচাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে এবং মাছের খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শামুক কমে গেলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর টিকে থাকার ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়বে, এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল বলেন, ‘শামুক শুধু পানির গুণগত মানই বজায় রাখে না, মাছের খাদ্যেরও অংশ। শামুক কমে গেলে জলজ প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমরা সরাসরি পদক্ষেপ নিতে পারি না, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি।’

কৃষি বিভাগ বলছে, শামুক কৃষিজমির উর্বরতা রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, ‘শামুক মাটিতে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ায়, যা দীর্ঘমেয়াদে ফসল উৎপাদনে সহায়ক। নির্বিচারে নিধন জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তার প্রভাব কৃষিতেও পড়বে।’

অর্থনৈতিক টানাপড়েনে জর্জরিত বিলপাড়ের মানুষদের জন্য শামুক সংগ্রহ সাময়িক আয়ের পথ তৈরি করলেও এর কারণে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ভারসাম্য। লোকালয়, কৃষিক্ষেত্র ও জলজ পরিবেশ, সবক্ষেত্রেই এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অনিবার্য হয়ে উঠছে। পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এখনই কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ, বিধিনিষেধ ও সচেতনতা কর্মসূচি না নিলে পাবনার বিলাঞ্চলের পরিবেশগত সঙ্কট আরো গভীর হবে। তাই শামুক আহরণে বিধিনিয়ম চালু, বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোই হতে পারে জীববৈচিত্র্য রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ।