২০২৪ সালের ৩৩ জুলাই (২ আগস্ট)। বাধা সত্বেও শুরু হয় সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্ষোভে অংশ নেন। তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবি জানান। এ দিন হবিগঞ্জ ও খুলনায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অন্তত দু’জন নিহত হন, যাদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে সংঘর্ষে এ দিন কমপক্ষে ১৫০ জন আহত হন।
ঢাকার উত্তরা, সিলেট, খুলনা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতেও বিক্ষোভ চলাকালে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হন। এ ছাড়াও সারা দেশে বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় আহত হন কয়েক শত বিক্ষোভকারী।
এইদিন রাতেই ঘোষণা করা হয় ৩৪ জুলাই (৩ আগস্ট) থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের। সারা দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়াসহ ৯ দফা দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার এদিন রাতে হোয়াটসঅ্যাপে এক বার্তায় এ ঘোষণা দেন। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও একই বার্তা শেয়ার করেন। অন্য দিকে আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ফেসবুক লাইভে এসে ৩ আগস্ট দেশব্যাপী বিক্ষোভের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ৩ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পালন করা হবে। কেউ ট্যাক্স এবং গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবে না। তিনি আরো বলেন, সচিবালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন ও রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
সরকারকে কেউ যাতে কোনো সহযোগিতা না করে এই আহ্বান জানিয়ে হান্নান বলেন, দেশের জনগণকে এমনভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে সরকার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে না পারে। এর আগে ১ আগস্ট আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, নুসরাত তাবাসসুম ও আবু বকর মজুমদার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজত থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পাওয়ার পর তারা এক যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করেন।
পুলিশ দাবি করে, নিরাপত্তার স্বার্থে ছাত্রনেতাদের ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়েছিল। তবে আন্দোলনকারীরা বলেন, তারা পুলিশের কাছে কোনো নিরাপত্তা চাননি। তাদের আটকে রাখা ছিল ‘অসাংবিধানিক ও বেআইনি’। ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়া সমন্বয়করা জানান, ৩০ জুলাই থেকে তারা ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় অনশন শুরু করেন। কিন্তু বিষয়টি পরিবারের কাছে গোপন রাখা হয় এবং তাদের জোর করে গোয়েন্দা কার্যালয়ের খাবার টেবিলে বসানো হয়। ডিবি কার্যালয় থেকে দেয়া আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি প্রসঙ্গে তারা বলেন, ওই বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি। এ দিন রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, মিরপুর-১০, আফতাবনগর ও শাহবাগে সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। টাঙ্গাইল শহরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন কয়েক হাজার আন্দোলনকারী, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী। রাজধানীতে ছাত্র, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে ‘দ্রোহযাত্রা’ নামে একটি গণমিছিল বের করেন। মিছিলটি শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পথে আরো অনেকে এতে যোগ দেন।
হাজারো বিক্ষোভকারী এ দ্রোহযাত্রায় অংশ নেন। তাদের হাতে ছিল ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ এবং ‘গুলিতে মরতে পারি, পিছু হটবো না’ লেখা প্ল্যাকার্ড। তারা গণগ্রেফতার বন্ধ, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার, গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি, কারফিউ প্রত্যাহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া এবং তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের দাবি জানান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এই ‘দ্রোহযাত্রা’ শুরুর আগে একটি সমাবেশে বক্তব্য দেন। দ্রোহযাত্রা শেষে শহীদ মিনারে এক সমাবেশে বক্তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ দাবিতে ৩ জুলাই বিকেল ৩টায় আরেকটি গণমিছিলের ডাক দেন। এ দিন ‘পোয়েটস অ্যান্ড রাইটারস অ্যাগেইনস্ট কান্ট্রিওয়াইড অ্যারেস্টস অ্যান্ড অপ্রেশন’ ব্যানারে শহরের নগর পরিকল্পনাবিদ, লেখক, কবি ও প্রকাশক এবং ‘প্রতিবাদ মঞ্চ’ ব্যানারে কিছু শিক্ষক ও অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীও রাজধানীতে আলাদা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এ ছাড়াও এদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২৬ জন শিক্ষক চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।
২ আগস্ট ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা এক বিবৃতিতে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা ও অস্থিরতায় শিশুদের ওপর প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সফর শেষে তিনি বলেন, ইউনিসেফ নিশ্চিত হয়েছে, জুলাই মাসের বিক্ষোভে অন্তত ৩২ জন শিশু নিহত হয়েছে এবং আরো অনেকেই আহত ও আটক হয়েছে। এটি একটি ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি। ইউনিসেফ সকল সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানায়। ইউনিসেফের বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে অন্তত ২০০ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৩২ জন ছিল শিশু। আরো অনেক মানুষ আহত ও আটক হয়েছেন।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে দমনপীড়ন শুরু করে। ২ আগস্ট পর্যন্ত চলা এক সপ্তাহব্যাপী ‘চিরুনি অভিযানে’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষার্থী, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। এ দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোটা নিয়ে ছাত্রদের দাবির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সত্ত্বেও একটি স্বার্থান্বেষী মহল সরকার ও ছাত্রদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা লুটতে অসৎ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’