আষাঢ়ের অবিরাম বৃষ্টিতে দেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এতে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির কারণে এরই মধ্যে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। বিভিন্ন জেলা শহরে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। অনেক জায়গা পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কোথাও বাঁধ ভাঙছে, কোথাও পাহাড় ধসে পড়ছে। এতে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ আরো দুই দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এতে পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের আশঙ্কা রয়েছে।
নয়া দিগন্তের প্রতিনিধিরা গতকাল জানিয়েছেন গত দুই দিনের বৃষ্টিপাতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকাগুলোতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, শরিয়তপুর, কক্সবাজার, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও চট্টগ্রামে। ফেনীতে রেকর্ড ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে মুহুরি, খাহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর অন্তত ১৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গিয়ে ৫০টিরও বেশি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর, রাস্তা ও কৃষিজমি, বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ ও যোগাযোগব্যবস্থা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই মুহূর্তে দেশের প্রায় ৩০টির বেশি জেলা কোনো না কোনোভাবে জলাবদ্ধতা বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রশাসন বলছে, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ আছে এবং প্রয়োজন হলে সেনা বা নৌবাহিনীকে মাঠে নামানো হবে।
কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও মহেশখালী এলাকায় পাহাড়ি ঢলে এবং অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি ও বিদ্যালয়। নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু এলাকা থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জেলার বিভিন্ন অংশে আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামেও পানি ঢুকে পড়েছে কর্ণফুলী, পাহাড়তলি ও বাঁশখালী এলাকার নিচু অংশে। পাহাড় ধসের আশঙ্কায় স্থানীয়দের সরে যেতে বলা হয়েছে।
উপকূলীয় পটুয়াখালী ও বরগুনার নদীবাঁধগুলোর ওপর তীব্র চাপ তৈরি হয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। এসব অঞ্চলে ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ফিশিং ট্রলার ও নৌযানকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের আরো ৫০ মিটার নদীতে
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, কয়েক বছর ভাঙন না থাকলেও ফের ভয়াল রূপে ফিরছে পদ্মা নদী। ইতোমধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধসহ স্থানীয়দের বসতবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়েছে। দ্বিতীয় দফার ভাঙনে নাওডোবার জিরো পয়েন্ট এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মিটার বাঁঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে দুইটি গ্রামের শতাধিক পরিবারের। গত সোমবার ভাঙন শুরু হলেও পরদিন মঙ্গলবার তেমন কোনো ভাঙন ছিল না। তবে দ্বিতীয় দফায় আজ বুধবার বিকেলে পদ্মা আবারো তার ভয়াল রূপ ধারণ করে। ভাঙন আতঙ্কে ইতোমধ্যে নদীর পাড় থেকে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা।
গত দুই দিনে পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের মোট ২০০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড।
স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল আবারো পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধের জিরো পয়েন্টে ভাঙন শুরু হয়।
বিকেল থেকে পদ্মার ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে নাওডোবার জিরো পয়েন্ট এলাকার দুইটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দুইটি বসতঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পদ্মার ভাঙন থামেনি। ফলে ভাঙন আতঙ্কে নদীর তীরবর্তী জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাফ খানের বাড়িসহ পাশের কয়েকটি বাড়ির স্থাপনা অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়দের আশঙ্কা দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নদীতে বিলীন হবে রাস্তাঘাট, হাটবাজারসহ শতাধিক বসতবাড়ি।
এ দিকে ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে স্থানীয়রা বলছেন, যে পরিমাণ ডাম্পিং করা হচ্ছে, তাতে ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। স্থায়ী প্রকল্পের ব্যবস্থা করা না হলে বিলীন হয়ে যাবে নাওডোবার বিস্তীর্ণ এলাকা।
টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে শরীয়তপুরের মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। পৌরসভার নিম্নাঞ্চলের অনেকের বসতঘরেও ঢুকে পড়েছে জমে থাকা বৃষ্টির পানি। শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের সামনে পানি জমে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সিভিল সার্জন অফিসের সামনে হাঁটু পানি জমে নিচতলায় পানি ঢুকে পরায় কর্মচারীদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ দিকে টানা বৃষ্টির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে মহাবিপাকে। সড়কে যানবাহন চলাচল করছে তুলনামূলক কম। স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও ছিল খুবই কম। ব্যবসা বাণিজ্যেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব।
পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকার কারণে সব এলকায় এখনো ড্রেনেজ-ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে যেসব এলাকায় জলাবদ্ধার সৃষ্টি হয়েছে ওই সব এলাকায় পৌরবাসীর কথা মাথায় রেখে শ্রমিকদের মাধ্যমে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শরীয়তপুর সিভিল সার্জন অফিসের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক এম এম হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের ভবনের কোন দিক দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ভারী বৃষ্টি হলেই জলবদ্ধতা দেখা দেয়। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে সিভিল সার্জন অফিসের নিচ তলায় পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে আমাদের অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
ফেনীতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ৫০ গ্রাম তলিয়ে গেছে
ছাগলনাইয়া-পরশুরাম (ফেনী) সংবাদদাতা জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে ও অস্বাভাবিক ভারী বর্ষণে ফেনী জেলার ভারত সীমান্তবর্তী মুহুরী নদী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ১৫টি স্থানে ভাঙনের কবলে নদী তীরবর্তী পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার ৫০টির অধিক গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওইসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৫৩২ জন বন্যাদুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনো খাবার প্রস্তুত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসন কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এ দিকে গত ৪৮ ঘণ্টায় ফেনীতে ৫৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ফেনীতে মাঝে মধ্যে হালকা বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে জেলার বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ফেনী জেলা আমির মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে জামায়াত, কুইক রেসপন্স টিমের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে। এ ছাড়া ফুলগাজীতে বিএনপি ও ইসলামী যুব আন্দোলনের নেতাকর্মীরা দুর্গত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করে। অপর দিকে গতকাল বিকেলে বিজিবি-৪ ফেনীর পক্ষ থেকে বিজিবির কুমিল্লা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কবিরের নেতৃত্বে পরশুরাম উপজেলার সীমান্তবর্তী অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ সময় বিজিবি-৪-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মো: মোশারফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন ।
গতকাল বিকেলে পর্যন্ত ছাগলনাইয়ায় মুহুরী নদীর পাড় ডুবে বন্যার পানির তোড়ে উপজেলার উত্তর সতর, দক্ষিণ সতর, এলনা পাথর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অপর দিকে ছাগলনাইয়া পৌর এলাকা, উপজেলার পাঠাননগর, রাধানগর, মহামায়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। উজানের পানির চাপ না কমলে রাতের মধ্যে ছাগলনাইয়া উপজেলার বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা । গতকাল বিকেল পর্যন্ত ফেনীতে ভারী বর্ষণ না হলেও ভারতের ত্রিপুরা থেকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদী হলে প্রবল বেগে বন্যার পানি প্রবেশ করায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এতে ফুলগাজীর ৯৯টি ও পরশুরামের ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও পরীক্ষা স্থগিত করে সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে জেলা প্রশাসন। গতকাল সকাল থেকে ফেনী-পরশুরাম ও উপজেলা সদরের সাথে আঞ্চলিক সড়কগুলোতে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকার লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ফসলি জমি, মাছের ঘের, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে জানা গেছে।
নোয়াখালী জেলা শহর তলিয়ে গেছে
নোয়াখালী অফিস জানায়, মৌসুমি বায়ু সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে টানা ভারী বৃষ্টিতে পাতে নোয়াখালী জেলা শহর পানিতে তলিয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে নোয়াখালী আবহাওয়া বিভাগ।
নিম্বচাপ ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত তিন দিনের ভারী টানা বৃষ্টিপাতের ফলে নোয়াখালী শহর হাঁটু পরিমাণ পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা বৃষ্টিতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে, মৎস্য ভবন, ফায়ার সার্ভিস, জেলা সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে পানি ডুবে গেছে, অনেক ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়া টাউন হল মোড়, ইসলামিয়া সড়ক, মহিলা কলেজ সড়ক, নোয়াখালী কলেজ সড়ক, জেল খানা সড়ক, মাইজদী বাজার সড়ক, ইসলামীয়া সড়ক বিভিন্ন বাড়ি ঘর, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে গেছে। অব্যাহত বৃষ্টির ফলে জেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী পৌরসভার বেশির ভাগ সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। জেলা সদর, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচর ও হাতিয়াসহ ৯টি উপজেলার নিচু এলাকার অনেক রাস্তাঘাট পানির নিচে। এতে অনেক মাছের প্রজেক্ট ভেসে যাওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। এ দিকে টানাভারী বষণ অব্যাহত এবং মহুরী নদীর পানি আরো বৃদ্ধি হলে বন্যার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করছে এলাকাবাসী। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সন্ধ্যায় টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বৃষ্টিপাত আরো কয়েকদিন চলতে পারে।
চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, দুর্ভোগ
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত সোমবার দুপুর খেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। গতকাল বুধবার সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি পড়েছে। চট্টগ্রামের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ বৃষ্টিতে নগরের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়ে বড়পোল, আগ্রাবাদ, চকবাজার, মেহেদীবাগ, কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দারা।
গতকাল সারাদিন নগরের মেহেদীবাগ এলাকায় কোমর পর্যন্ত পানি জমে যায়। যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটে। পানি ঢোকে দোকানপাটে। দুর্ভোগে পড়ে বাসিন্দা ও পথচারীরা। একই অবস্থা নগরের বড়পোল এলাকায়। বৃষ্টির পানির সাথে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় বিশাল এলাকা। আগ্রাবাদ এলাকায় চট্টগ্রাম নগরের বেশির ভাগ ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রাতের বৃষ্টিতে সকালে টইটম্বুর হয়ে উঠে আগ্রাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায়। অনেকেই সকালে পানি মাড়িয়ে অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়েছে। বিকেলেও একই অবস্থা। অধিকাংশ সড়কজুড়ে পানি জমেছে।
চট্টগ্রাম পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৩.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও চট্টগ্রামসহ দেশের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এর ফলে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নগরের কিছু জায়গায় রাস্তা উঁচু কিন্তু লিংক রোডগুলো নিচু। এসব জায়গায় ড্রেনগুলো বারবার পরিষ্কার করেও লাভ হচ্ছে না।
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে চার দিনের টানা ভারী বর্ষণে আবারো নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেক এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী অনেকে। উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ফেনাপুনি, দুয়ারু, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড, মায়ানী ইউনিয়নের পূর্ব মায়ানী গ্রামের পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে।
রোববার থেকে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায় পানি ঢুকেছে। তখন থেকে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকা। খৈয়াছরা খাল সংস্কার বন্ধ থাকায় পানিবন্দী হয়েছে ওই এলাকার শতাধিক পরিবার।
প্রতিবারের মতো এবারো ফেনাপুনি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ওই গ্রামের প্রায় পরিবারের রান্নাঘরে পানি ঢুকে গেছে। ফেনাপুনি কমিউনিটি ক্লিনিকে পানি ঢুকে গেছে।
চকরিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, টানা চার দিনের ভারী বর্ষণে চকরিয়া-আলীকদম সড়কের মিরিঞ্জা নামক স্থানে পাহাড়ধসে পড়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় চকরিয়া পৌর শহরে নতুন নতুন এলাকা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গতকাল বুধবার সকালে পাহাড়ধসে চকরিয়া-লামা-আলিকদম সড়কের মিরিঞ্জা অংশ বন্ধ হয়ে যায়।
এ দিকে মৌসুমি বায়ুর সমুদ্রের নিম্নচাপের প্রভাবে চকরিয়া ও পেকুয়ায় থেমে থেমে ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে উজান থেকে বৃষ্টি পানি নেমে মাতামুহুরী নদীর পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে উপজেলার উপকূলীয় বদরখালী, ইলিশিয়া, বিএমচর, হারবাং, কাকরা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমু, বরইতলী ও পেকুয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চলে ঢলের ঢুকে পড়েছে। এতে এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছে খেটেখাওয়া মানুষগুলো।
কুমিল্লায় প্রস্তুত ৫৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্র
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, টানা মাঝারি ও ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে ২৪-এর মতো আবারো দেখা দিতে পারে ভয়াবহ বন্যা। এতে গোমতী আশপাশের স্থায়ী বাসিন্দাদের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভারতে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় পানির স্রোত কিছুটা কমেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্যার সতর্কতা জারি করা হবে।
কুমিল্লা আবহাওয়া কর্মকর্তা ছৈয়দ আরিফুর রহমান জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার বেলা ৩টা থেকে গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লায় ১২৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার মাঝারি বৃষ্টি হলেও গতকাল থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেই সাথে ঝড়ো হাওয়াও ছিল কোথাও কোথাও। আগামী দু-এক দিন একই অবস্থায় বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো: আমিরুল কায়ছার বলেন, মঙ্গলবার থেকে গোমতী নদীর পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তার পরও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগাম বন্যা প্রস্তুতি রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার এবং জিআর চাল মজুদ রাখা হয়েছে। একই সাথে ৫৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ভারতের পানিতে ডুবতে বসেছে কুমিল্লার ৪ লাখ মানুষ
বুড়িচং (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বর্ষণে হু হু করে বাড়ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। ফলে ডুবতে বসেছে জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের চার লাখ ১৬ হাজার মানুষ।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি প্রায় ৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢল। ত্রিপুরার পানি গোমতী হয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে পড়ায় কুমিল্লার নিম্নাঞ্চল ঝুঁকিতে পড়েছে।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আরিফ বলেন, সাগরে একটি লঘুচাপ রয়েছে, তবে তা ভারতের অংশে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে আরও বৃষ্টিপাত হতে পারে।
গোমতীর পানি বৃদ্ধি ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন সম্ভাব্য বন্যার আগাম প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।