পিআরআইর আলোচনা

বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা চাই, ব্যাংকিং বিভাগের বিলুপ্তি চাই : আমীর খসরু

ব্যাংক খাতের সব সূচক খারাপ হয়ে পড়েছে। আগে থেকেই আমরা তা জানতাম। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর বিষয়টি আনুষ্ঠানিক হয়েছে। প্রকৃত চেহারা বের হচ্ছে। এত দিন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা দিতে হবে। তার মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং বিভাগ বিলুপ্ত করে দিতে হবে। ব্যাংক খাতে দ্বৈত শাসন চলবে না।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বিগত সরকারের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। যাদের কোনো ব্যবসা নেই, তাদেরও ঋণ দেয়া হয়েছিল। কয়েকটি পরিবারের কাছে ব্যাংকগুলোকে তুলে দেয়া হয়েছে। লুটপাট ঠেকানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো ভূমিকা ছিল না। এতে উত্তরণের জন্য এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সমধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য।

‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গতকাল মঙ্গলবার এই আলোচনার আয়োজক ছিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ও চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার সমাপনী বক্তব্য দেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সুদহার ও ডলারের দাম ঠিক করা হয়েছে। ডলারের ওপর চাপ কমাতে দাম ধরে রাখা হয়েছে, অন্য দিকে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এতে খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসব স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে বাংলাদেশের ব্যাংকের শুধু স্বাধীনতা দিলেই হবে না, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে আমরা কখনো পলিটিক্যাল লোক নিয়োগ করিনি। আমরা ব্যাংকিং ডিভিশন (আর্থিক বিভাগ) বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ এটার কোনো ভূমিকা ছিল না। তারাই আবার পরে এটা ফেরত এনেছে। তাতে আরো নানা রকমের সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমরা আবারো সরকারে এলে এই বিভাগকে বিলুপ্ত করে দেবো।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যত বড় ধরনের সংস্কার হয়েছে, তা বিএনপির সময়েই হয়েছে। ব্যাংকগুলো শর্ট টার্ম ডিপোজিট নিয়ে লং টার্ম লেন্ডিং করছে। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেট উন্নতি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যত সংস্কার করুক না কেন, তাতে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মার্কেট বলতে কিছু নেই।

আমীর খসরু বলেন, আমরা এক কোটি চাকরি তৈরি করব ১৮ মাসে। কিভাবে করব- আইটি, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ও বিদেশে জনশক্তি দিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরকেও এগিয়ে আসতে হবে।

টাকা ছাপানো থেকে বের হয়ে আসতে হবে জানিয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিমান কেনার জন্য সরকার টাকা দেবে। এটা হতে পারে না। বিমান বন্ড ছেড়ে টাকা তুলতে পারে। সরকারের টাকা খরচ হওয়া উচিত সমাজের উন্নয়নে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সরকার খরচ করতে পারে।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা, প্রবৃদ্ধিকে সহায়তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং আর্থিক খাতে সুশাসন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। বাজারব্যবস্থা যদি মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্বাসযোগ্য বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি। আমলাদের গভর্নর করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে কয়েকটি পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সুদহার ও ডলারের দাম ঠিক হয়েছে। ওই সময় দেশ থেকে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা দিতে হবে। সেটা দিতে হবে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতের সব সূচক খারাপ হয়ে পড়েছে। আগে থেকেই আমরা তা জানতাম। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর বিষয়টি আনুষ্ঠানিক হয়েছে। প্রকৃত চেহারা বের হচ্ছে। এত দিন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা দিতে হবে। তার মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং বিভাগ বিলুপ্ত করে দিতে হবে। ব্যাংক খাতে দ্বৈত শাসন চলবে না।

অনুষ্ঠানে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর বলেন, ২০১৯ সাল থেকে আমরা ডলারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে আসছিলাম। সেটা না করে ২০২২ সালে ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যার চাপ সবাইকে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির ধারাবাহিকতা থাকা জরুরি। ব্যাংকিং বিভাগকে অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে। বিএনপির রাজনৈতিক এজেন্ডার মধ্যে এটা থাকা দরকার।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ আখতার হোসেন প্রমুখ।