অন্তর্বর্তী সরকারের দেয়া সাত দিনের সময়সীমা পেরোতে চললেও গণভোট ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি। সরকারের নির্ধারিত আলোচনার সময়সীমার পঞ্চম দিন শনিবার পর্যন্ত বড় কোনো দলই আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় বসেনি। ফলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে জানানো হয়েছিল, গণভোট, নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলতে হবে। তবে সেই সময়সীমা শেষ হতে চললেও বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও অন্য দলের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক সংলাপ হয়নি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, সরকার যে সময়সীমা বেঁধেছে, তা রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় কোনো পুনর্মিলন হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যস্থতাও সব সমস্যার সমাধান আনতে পারেনি। এ অবস্থায় সাত দিনের মধ্যে দলগুলোকে একমত করানো চ্যালেঞ্জিং।
এ অবস্থায় সরকার গণভোট নিয়ে কী আদেশ জারি করে সেটির অপেক্ষায় আছেন সবাই।
দলগুলোর অবস্থান : অবিশ্বাসের দেয়াল
বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, তারা এই ইস্যুতে নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছেন। সরকারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো আলোচনাও হয়নি। জামায়াত আলোচনার জন্য দুই নেতার একটি কমিটি করে দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৬ নভেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সর্বসম্মতভাবে গৃহীত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রশ্ন বা সঙ্কট সৃষ্টি করা যাবে না। জনগণ ও ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের ত্যাগকে সম্মান জানিয়ে বিএনপি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কাজ করবে।’ তিনি আরো বলেন, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় উপনীত বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং নতুন প্রশ্ন বা সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করবে না। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে, জুলাই সনদের আইনানুগ বাস্তবায়ন এবং সময়মতো জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। বিএনপি মহাসচিব স্পষ্ট করেই বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হবে। সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো ভোট হবে না।’
গণভোট ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হবে। এটি জনগণের দাবি। তিনি আরো বলেন, এই দাবিকে অবহেলা করা যাবে না। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম জানান, বিএনপির সাথে আলোচনার চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে জামায়াত সবসময় আলোচনার জন্য প্রস্তুত। ১১ নভেম্বর তাদের সমাবেশে এ বিষয়ে অবস্থান ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, পাঁচ দিন পার হলেও গণভোট নিয়ে কেউ স্বপ্রণোদিতভাবে কথা বলেননি। তিনি উল্লেখ করেন, এনসিপি, এ বি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদসহ কিছু দল আলোচনা করেছেন, তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের বেঁধে দেয়া সময় যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে ইস্যুর সমাধান চাওয়ায় তারা আন্তরিক।
এনসিপি নেতা সরোয়ার তুষার বলেছেন, নতুন করে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হওয়ার প্রয়োজন নেই।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি ও সরকারের বিলম্বিত পদক্ষেপ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সঙ্কট নিরসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে। তবে তারা এখনো বিএনপি বা জামায়াতের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি বলে দলটির সিনিয়র পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছে।
এনসিপি নেতা বলেছেন, জুলাই সনদের ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়ার পরেই কমিশন সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টাকে জুলাই আদেশ জারি করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, “কমিশন সব পক্ষের মতামত বিবেচনা করেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছে। সরকারের কাজ ছিল সেখান থেকে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সব দলের মত এক হওয়া সম্ভব নয়- এই বাস্তবতা জেনেই কমিশন গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এখন সরকারের পুনরায় দলগুলোর কাছে ফিরে যাওয়া কেবল বিভ্রান্তি ও বিলম্ব বাড়াচ্ছে। এতে সন্দেহ জাগে, এর পেছনে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে কি না।”
সরোয়ার তুষার সরকারের অবস্থানকে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, “সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত নিরপেক্ষ রেফারির মতো, যিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন, কিন্তু নিষ্ক্রিয় থাকেন না। বর্তমানে সরকার নিরপেক্ষতা আর নিষ্ক্রিয়তার পার্থক্য বুঝতে পারছে না বলেই পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।”
তিনি চূড়ান্ত গণভোটের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেও সরকারের বিলম্ব করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তুষার মনে করেন, “যখন গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে অর্থাৎ জনগণই চূড়ান্ত রায় দেবে তখন আবার দলগুলোর মতভেদে ফিরে যাওয়ার মানে নেই। সরকারের এই পদক্ষেপ নির্বাচনী পরিবেশ ও স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা দেশের জন্য বিপজ্জনক ইঙ্গিত।”
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, কয়েকটি দলের সাথে আমাদের আলোচনা হয়েছে, তবে বিএনপি বা জামায়াতের সাথে নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐকমত্যে না আসতে পারে, তাহলে সরকারকেই জুলাই সনদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জুলাই সনদ নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, গণভোট অবশ্যই হতে হবে এবং আমরা বলেছি জুলাই সনদের আদেশ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে দিতে হবে। জুলাই সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বলে কিছু থাকবে না।
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা : এ দিকে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক নয়া দিগন্তকে বলেছেন, গণভোটের সাথে জনগণ পরিচিত না। এখন কোন প্রশ্নে গণভোট হবে, গণভোটের ফলাফলের পরিণতি কী হবে, এগুলো নিয়ে তো কোনো আলাপ-আলোচনাই হয়নি। খালি গণভোট চাই আর গণভোট চাই না, গণভোট করতে হলে যে আইন তৈরি করতে হবে, আইনে এগুলো বলে রাখতে হবে, গণভোটের জন্য যে ব্যবস্থা করা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এগুলো তো বাস্তবিক অর্থে নেই। যেটা কাম্য বা অকাম্য সেটা পরের কথা কিন্তু বাস্তবিকভাবে এটার বাস্তবায়নটা তো এখন অসম্ভবের পর্যায়ের দিকে চলে গেছে।
এর আগে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, ‘দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘাটতি গণভোট ইস্যুতে সমঝোতা ব্যাহত করছে। এর ফলে ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন আরো অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে।’
অন্য দিকে বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেছেন, সংবিধানে গণভোট সম্ভব না এমন বক্তব্য যারা দিচ্ছেন তারা বুঝতে পারেন না গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট কাকে বলে। তারা আন্ডারমাইন্ড করেন গণ-অভ্যুত্থানকে। একটা ভুল রিডিং হচ্ছে। ট্রাডিশনিলিজিম আর প্রাগমেটিজম আলাদা। ট্রাডিশনাল ব্যাখ্যা যদি আপনি দেন, এই চোখে যদি আপনি দেখেন, এই চশমা যদি আপনার চোখে থাকে, তাহলে আপনি ব্যাখ্যা দেবেন ট্রাডিশনাল। আর যদি প্রাগমিটিক হন, কনটেক্সটকে বিবেচনা করেন, তাহলে আপনি ব্যাখ্যা দেবেন উইথ দি কনটেক্সট, কোনো একটা কনটেক্সট কোনো একটা ডকুমেন্টের বাইরে পড়লে ভুল হয়। আপনি আজকের কাজ বা সব আয়োজন ৫ আগস্টের বাইরে গিয়ে পড়লে ভুল হবে, ৫ আগস্টকে সরিয়ে দিলে আমরা কেউ থাকব না। কনটেক্সট চেঞ্জ হয়ে যাবে। এখানে একটা ভুল ইন্টারপ্রিটেশন কেউ কেউ দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা: সাখওয়াত হোসেন সায়ান্ত বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আলোচনা সফল হওয়ার ঐতিহ্য নেই। অতীতে কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ সফল হয়নি। তাই সাতদিনে দলগুলো একমত হবে, তা আশা করা যায় না। তবে ঐকমত্য কমিশনে গৃহীত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’ তিনি আরো বলেন, সরকার এই ইস্যুটি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে, যা দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলও হতে পারে।
নির্বাচনের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করে সায়ান্ত বলেন, যদি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে বিএনপির প্রার্থীরা ধরে নেবেন তারা এমপি হবেন। এতে তারা ও তাদের সমর্থকরা রাজপথে নামবেন, যা সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এবং পতিত ফ্যাসিস্টদের সুযোগ দিতে পারে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা : রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, ‘দলগুলো নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। গণভোট নিয়ে আলোচনা না হওয়ার মানে হলো- তারা এখনো নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। এতে করে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত বা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার পথ খোলা রাখা। যদি রাজনৈতিক সমঝোতা না হয়, তাহলে সরকারকেই বিকল্প রূপরেখা দিতে হবে।’
অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গণভোট ও নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাজারে একধরনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও ‘দেখি কি হয়’ নীতিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সরকারি সূত্র জানায়, আলোচনায় অগ্রগতি না হলে গণভোট প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সরকার বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনা করছে, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট। ‘সমঝোতার পথ খোলা থাকবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।’
গণভোট ইস্যুতে দলগুলোর অবস্থান আজ যে দূরত্বে পৌঁছেছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর সঙ্কটের প্রতিচ্ছবি। জুলাই বিপ্লবের পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও দলীয় রাজনীতির মধ্যে এখনো নতুন সামাজিক চুক্তির মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়নি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এগিয়ে আসছে; কিন্তু জাতির সামনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। গণভোট ছাড়া কি সত্যিই নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু করা সম্ভব? নাকি বাংলাদেশ আবারো অনিশ্চয়তার বৃত্তে ফিরে যাবে?



