বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু হেনা রাজ্জাকী বলেছেন, জুলাই সনদ ঘোষণা এখন সময়ের দাবি। এর সাথে সাংবিধানিক সঙ্কটের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সাংবিধানিক সঙ্কট হয়নি, হবেও না। সংবিধান বিলুপ্ত বা বাতিলের কথাও কেউ কেউ বলছেন। আদৌ সংবিধান নেই তারা তা ভাবছেন না বা স্বীকার করছেন না। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, জুলাই ঘোষণার পর সব মিলে একটা সংবিধান দাঁড়াবে। কিন্তু দেশে এখন সংবিধান নেই। সংবিধান ছুড়ে ফেলে গেছেন শেখ হাসিনা। তিনি সংবিধান বিলুপ্ত করে গেছেন। প্রথমত, তিনি সাংবিধানিক দায়িত্ব বুঝিয়ে দেননি। আর দুই নম্বর হচ্ছে, এই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেহেতু সংবিধান নেই, সংবিধানের বাইরের সরকার এবং অলিখিত সংবিধান দিয়ে দেশ চলছে।
আবু হেনা রাজ্জাকী বলেন, দেশ চলছে ব্রিটেনের মতো অলিখিত সংবিধানে। সংবিধান আদৌ আছে কি না, বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এ নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। বর্তমান যে সরকার আছে তার স্ট্যাটাসটা কী? দেশ চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, সাংবিধানিক সরকারের অধীনে নয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। সাংবিধানিক সরকার প্রধান নন। সংবিধানে দুইটা সরকারের কথা বলা আছে, একটা হলো সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে সরকারটা গঠন করবে, সেটি হলো একটা সরকার। আরেকটা সরকারের কথা বলা আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যেটা বাতিল হয়েছিল আবার সম্প্রতিককালে হাইকোর্ট বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত দেবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কথা সংবিধানে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো মেয়াদ নেই। তার কর্মকাণ্ড কী সে ব্যাপারে বলা নেই। আমাদের আগের সংবিধানে বলা ছিল- প্রধানমন্ত্রীর কার্যাবলি কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যাবলি কী? কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু সংবিধানে নেই, তার কার্যাবলিও নেই। বর্তমান সরকারের স্ট্যাটাস হলো একটা অলিখিত সংবিধানে চলছে। ধরে নিতে পারেন দেশ ব্রিটেনের মতো একটা অলিখিত সংবিধানে আছে। কারণ সে যদি মূল সংবিধান ফলো করে তাহলে তো কোনো স্ট্যাটাসের সরকারই না সংবিধান মোতাবেক। তাহলে সে ওইটা ফলো করবে কেমনে?
তিনি বলেন, সংবিধানে প্রধান উপদেষ্টার পদও নেই। আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং তিনি প্রধান উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান বা এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। রাষ্ট্রপতি যদি ভাবেন যে, তিনি সাংবিধানিক সরকারপ্রধান তাহলে প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু কোনো সাংবিধানিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নন। কাজেই এই রাষ্ট্রপতি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রযোজ্য নয়। সুপ্রিম কোর্ট ১০৬ ধারা হিসেবে একটা রেফারেন্স দিয়েছেন, সেই রেফারেন্সের ভিত্তিতে দলমত নির্বিশেষে, আমলা, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীপ্রধানসহ সবাই বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং এ নিয়ে কে কী বলল তা ইমম্যাটেরিয়াল; বরং রাষ্ট্রপতি যিনি আছেন বর্তমান তিনি যদি ওই সংবিধানের অধীনে হন তো ওই সংবিধান এখন নেই, তাই তিনি রাষ্ট্রপতিও এখন নেই। কারণ রাষ্ট্রপতি তাকে শপথ পড়িয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে।
নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী এসব কথা বলেন।
নয়া দিগন্ত : এই বিতর্কের শুরু কি হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে?
আবু হেনা রাজ্জাকী : সাংবিধানিকভাবে যে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বাংলাদেশে কোনো প্রধানমন্ত্রী তার দায়িত্ব ফেলে বা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে কাউকে। স্কুলের একজন হেডমাস্টার কিংবা কলেজের একজন প্রিন্সিপ্যাল দায়িত্ব পালন থেকে চলে যেতে পারে না পালায়া। তাকে দায়িত্ব কাউকে বুঝায়া দিতে হয়। বাংলাদেশে বহু অভ্যুত্থান হয়েছে কোনো সরকার পালায় নাই। তিনি যখন পালাইছেন তখন ডাস্টবিনে সংবিধান ছুড়ে চলে গেছেন। সংবিধান তো তাকে পারমিট করে না। এভাবে চলে যাওয়া। তার মানে হাসিনা তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে চেতনাকে ক্যাশ করে চলে গেছেন এবং সংবিধানটাকে উনি বিক্রি, ধূলিসাৎ মানে স্থগিত করে গেছেন। সংবিধানটাকে ইনফ্যাক্ট ছুড়ে ফেলে গেছেন এবং যেই সংবিধান উনি ছুড়ে ফেলে গেছেন সেই সংবিধান যেহেতু নাই সেহেতু রাষ্ট্রপতিরও কোনো স্ট্যাটাস নাই।
নয়া দিগন্ত : সংবিধান নাই, তাহলে কি নতুন সংবিধানের প্রয়োজন নাই?
আবু হেনা রাজ্জাকী : সংবিধান কোথায়, সংবিধান থাকলে সংস্কারের আলোচনা চলছে, এ মুহূর্তে স্ট্যাটাস কোনটা? কালকে নির্বাচন এলে কোন সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করবেন। যেহেতু সংস্কার নিয়ে আলোচনা করছেন তাহলে সংস্কারের পর একটা সংবিধান দাঁড়াবে এবং এ সংস্কার করছে কে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ অলিখিত সংবিধানের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সরকার এবং সে একটা লিখিত সংবিধান দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং সে যখন বঙ্গভবনে শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে শপথ নেয়। তখন বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিকদল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কর্মচারী, সচিব, তিন বাহিনীর প্রধানগণ সবাই বঙ্গভবনে ছিলেন। অর্থাৎ পুরা রাষ্ট্র একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার এবং অলিখিত সংবিধান দিয়ে চলার তাকে একটা অধিকার দিয়েছেন। সুতরাং সেই মোতাবেক তিনি চলমান। কাজেই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে। যেহেতু সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে প্রধানমন্ত্রী না বলে চলে গেছেন। ফলে বাংলাদেশ চলছে অলিখিত সংবিধান দিয়ে।
নয়া দিগন্ত : বলা হচ্ছে জুলাই সনদ ঘোষণা দিলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে?
আবু হেনা রাজ্জাকী : যারা বলছেন বা বিতর্ক করছেন তারা হাইপোথিসিস ধরনের কথা বলছেন। আপনি তো জানেন না আপনার জীবনে পরবর্তী সময়ে কী আসছে? আপনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ যা কিছু হন না কেন, আপনি আপনার জীবনের পরবর্তী মুহূর্তে কী আসতেছে আপনি তা জানেন না। তাহলে বিশৃঙ্খলার পূর্বাভাস যারা করছেন, প্রেডিকশন দিচ্ছেন আপনি কে? কারা আপনারা যারা বিশৃঙ্খলার শঙ্কার কথা বলছেন, এর কোনো ভ্যালু নেই। আমি যা বলছি যা ঘটেছে তার ওপর। আর ভবিষ্যৎ তো আমরা কেউ দেখি না। আপনিতো ৬০ বছর বাতাসের মধ্যে থেকে বাতাসের রঙ দেখেন না। এখন সবাই বলবেন বাতাসের রঙ নাই। আপনি দেখেন না বলে বলতেছেন বাতাসের রঙ নাই। রঙ যে নাই আপনি কিভাবে গ্যারান্টি দিলেন। সুতরাং কী ঘটবে সংবিধান বিলুপ্ত হলে? সংবিধান তো অলরেডি নাই। আপনার তো মূল সংবিধানের জন্য অলরেডি আলোচনা চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে। এটা না নির্বাচিত সরকার, না তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এটা তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সমস্ত রাজনৈতিকদল বঙ্গভবনে বসে এটাকে অ্যাপ্রুভাল দিয়ে আসছে। সেই শপথ সিরোমনিতে ছিল সবাই।
নয়া দিগন্ত : কারো কারো ধারণা রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন?
আবু হেনা রাজ্জাকী : রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো এখতিয়ার নাই। সংবিধানই যেহেতু নাই উনি কিভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অলিখিত সংবিধানে চলছে দেশ। আপনি কে? রাষ্ট্রপতি কে? রাষ্ট্রপতি ‘ব্যক্তিত্বহীন’ বলেই বসে আছেন।
নয়া দিগন্ত : জুলাই সনদ ঘোষণা তো সময়ের দাবি?
আবু হেনা রাজ্জাকী : হ্যাঁ জুলাই সনদ ঘোষণা সময়ের দাবি। কিন্তু মব বলে অহেতুক ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। বাজারে মবের নামে বয়ান ছাড়া হচ্ছে। একটা মব দিয়া যখন রাষ্ট্রীয় মবকে কবর দেয়া হয় সেই মব যখন জনগণ এক্সসেপ্ট করে ব্যাপকভাবে তখন সেই মবটা হয় ন্যায়বিচার। জুলাইয়ের আন্দোলনকে যদি আপনি মব বলেন, সেটি তো মব, আইন হাতে তুলে নিয়েছে, সরকারকে তাড়ানোর জন্যে। কিন্তু এ মব দিয়ে কী করছে? যে মব আয়নাঘর বানাইছিল, যে মব বিনাবিচারে হত্যা করত, যে মব ক্রসফায়ার দিয়ে মানুষ মারত, যে মব গুম করত সরকারিভাবে, রাতের ভোট করত, মিডিয়া সমর্থন দিয়ে মব করেছে, ব্যাংকের টাকা লুট করে অর্থনৈতিক মব করছে, এসব মবকে কবর দেওয়ার জন্যে জুলাইতে যে আন্দোলন হয়েছে এটাকে যদি আমি মব বলি, কিন্তু মবের কারণে যখন সরকার পালিয়ে গেল, তখন এটা ন্যায়বিচার হলো জাতির কাছে। যার কারণে বঙ্গভবনে নিয়ে শপথ পড়ানো হলো তখনকার সরকারকে। তখন কিন্তু কেউ বলেনি মবের মাধ্যমে সরকার পতন হয়েছে। এটা কিন্তু কেউ বলে না। দ্যাট ওয়াজ দা ডিমান্ড অব দি কান্ট্রি। এই কান্ট্রির ডিমান্ডে যে মব হয় সেটি ন্যায়বিচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাজেই ৩৬ শে জুলাই মবটা ছিল দেশের জন্যে একটা বিরাট ন্যায়বিচারের শামিল। এটাকে বলতে পারেন মবজাস্টিস। ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে গেলেন এই মবের কারণে তারপর যে ৩২ নম্বরের বাড়িটা ভাঙ্গা হলো সেটিকে আমরা সমর্থন করি না। দ্যাট ইজ মব মুভমেন্ট, মব সন্ত্রাস। কিন্তু ৩৬ জুলাইয়ের আন্দোলন যেটা হয়েছে সেটি হলো মব জাস্টিস। এটাকে সারা দেশে গ্রহণ করছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি এক্সসেপ্ট করছেন। সামরিক বাহিনীর প্রধান এক্সসেপ্ট করছেন। বিচারপতি এক্সসেপ্ট করছেন। রাজনীতিবিদরা এক্সসেপ্ট করছেন।