সুদের হারের ঊর্ধ্বগতি

২০২৫ সালে ব্যাংকঋণ আরো ব্যয়বহুল হলো

জুলাই ২০২৫-এ ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশে, যা জানুয়ারির তুলনায় প্রায় ০.২৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। অন্য দিকে গড় আমানত সুদহার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশে, ফলে ঋণ-আমানত সুদ ব্যবধান নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে, যা খাতটির সুদবাজারে প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

জুলাইয়ে গড় ঋণ (শতাংশ)

  • সুদহার ১২.১৪
  • আমানতের সুদ ৬.৩৯
  • স্প্রেড কমে ৫.৭৫

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ঋণ সুদের হার বেড়ে স্থিতিশীলভাবে উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর আমানতের সুদ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় তা এখনো নেতিবাচক প্রকৃত রিটার্নে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২৫-এ ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশে, যা জানুয়ারির তুলনায় প্রায় ০.২৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।

অন্য দিকে গড় আমানত সুদহার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশে, ফলে ঋণ-আমানত সুদ ব্যবধান (¯েপ্রড) নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে, যা খাতটির সুদবাজারে প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিসংখ্যান বিভাগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগ (২০২৫) সূত্র অনুসারে, ব্যাংক রেট স্থিতিশীল, কিন্তু বাজারে অর্থের দাম বেড়েছে ২০২৪ সালের পুরো সময় জুড়ে এবং ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার (ব্যাংক রেট) স্থির রয়েছে ৪ শতাংশে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি তহবিল ধার করার হার ‘গড় কলমানি হার’ চলতি বছরে গড়ে ১০ শতাংশের আশপাশে ঘুরছে। জানুয়ারিতে এটি ছিল ১০.০৮ শতাংশ, আর আগস্টে ৯.৯৮ শতাংশ।

এর মানে হলো, নীতি সুদহার অপরিবর্তিত থাকলেও আন্তঃব্যাংক বাজারে তহবিলের প্রকৃত ব্যয় বেড়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

২০২৪ থেকে ২০২৫ : ঊর্ধ্বমুখী ধারার বিশ্লেষণ : তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ১১.৫২ শতাংশ। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এটি বেড়ে ১২ শতাংশের উপরে গেছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অন্য দিকে, গড় আমানত সুদও বেড়ে ৪.৯২ শতাংশ থেকে ৬.৩৯ শতাংশে পৌঁছেছে, তবে দেশের মুদ্রাস্ফীতি (প্রায় ৮%) বিবেচনায় আমানতকারীরা এখনো প্রকৃতভাবে ক্ষতির মুখে রয়েছেন।

কেন বাড়ছে ঋণের সুদ : অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত বিশ্লেষকদের মতে, ঋণের সুদ বৃদ্ধির পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে- প্রথমত, তারল্য সঙ্কট ও উচ্চ সরকারি ঋণ গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে সরকার ও করপোরেট খাত উভয়ের তহবিল চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে ঋণদানের সক্ষমতা সঙ্কুচিত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, অবাধ সুদহার নীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সালের শেষ দিকে ‘স্মার্ট রেট’ নীতি তুলে দেয়ার পর ব্যাংকগুলো বাজার নির্ধারিত হারে ঋণ দিচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও ঋণের সুদহার বাড়ছে।

তৃতীয়ত, ঝুঁকি সমন্বয় ও খেলাপি ঋণ উদ্বেগ। এ ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ঝুঁকির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঋণের সুদে বাড়তি মার্জিন যোগ করছে।

বিশেষজ্ঞ মত : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অর্থনীতিবিদের ধারণা- ‘মুদ্রানীতি স্থিতিশীল থাকলেও বাজারে অর্থের দাম বেড়ে যাওয়ার মানে হলো- ব্যাংকিং খাতের তারল্য চাপে রয়েছে। আমানতের সুদ যদি যথেষ্ট না বাড়ে, তা হলে জনগণের সঞ্চয় ব্যাংক ব্যবস্থায় টানতে সমস্যা হবে।’

তিনি মনে করেন, ঋণের সুদহার ১২ শতাংশের উপরে অবস্থান করা ব্যবসায় বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান : বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণনীতি বিভাগ জানিয়েছে, ব্যাংক রেট স্থির রাখলেও বাজারভিত্তিক সুদ নির্ধারণের সুযোগ অব্যাহত থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা সুদের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছি না। তবে ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদহার যৌক্তিক রাখতে এবং আমানতের হার বাড়িয়ে জনগণের সঞ্চয় উৎসাহিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি : আর্থিক খাত পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ২০২৫ সালের শেষার্ধে যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সরকারি ঋণ গ্রহণ কমে, তবে ঋণের সুদ কিছুটা কমতে পারে। অন্যথায়, বিদ্যমান তারল্য সঙ্কট ও আমানত ঘাটতি বজায় থাকলে ১২ শতাংশের ঊর্ধ্বে সুদহার দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- ব্যাংক রেট অপরিবর্তিত রয়েছে- ৪.০ শতাংশে, জুলাই ২০২৫-এ ঋণের গড় সুদহার দাঁড়ায় ১২.১৪ শতাংশে; আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৬.৩৯ শতাংশে; প্রতিযোগিতা বাড়ায় ¯েপ্রড নেমেছে ৫.৭৫ শতাংশে আর উচ্চ সুদ বিনিয়োগে চাপ সৃষ্টি করছে। এতে আমানতকারীরা এখনো প্রকৃত ক্ষতির মুখে, তাদের আমানতকৃত অর্থ স্থিরমূল্যে কমে যাচ্ছে।