অনিয়মে ডুবছে মনিপুর স্কুল কোটি টাকা লোপাট

৩০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও বছরে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার বেশি আয়ের এই প্রতিষ্ঠানটিই যেন এক ‘সোনার ডিম’, যার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া একটি স্বার্থান্বেষী চক্র। অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সাবেক সভাপতি তাহমিনা আক্তার এবং অভিভাবক প্রতিনিধি শাকিল মোল্লার নেতৃত্বে থাকা একটি সিন্ডিকেট গত কয়েক মাস ধরে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে রাজধানীর একসময়ের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বিশেষ করে বিগত ১৬ বছরে স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে স্থানীয় সংসদ সদস্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের কারণেই মূলত শিক্ষাদানের কৌশল ও মানে বড় ধরনের পতন ঘটে এখানে। ব্যক্তিস্বার্থই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছিল বিগত বছরগুলোতে। তবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর এবং আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হওয়ার পরেও এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং কথিত আছে আগের সময়ের চেয়ে বর্তমান সময়ে আরো বেশি অনিয়ম আর আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে। সদ্য সাবেক অ্যাডহক কমিটির হাতে পরিচালনার দায়িত্ব থাকাকালে এ যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত বসেছিল মনিপুর স্কুলে। এখানকার অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে স্কুলের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র।

মিরপুরের একটি ক্যাস্পাসে সরেজমিনে গিয়ে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে শিক্ষানগরী ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ বর্তমানে ভয়াবহ আর্থিক অনিয়ম ও ক্ষমতা অপব্যবহারের এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সরকারের নির্দেশনায় গত ৩০ অক্টোবর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন স্কুল কলেজের অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষে জেলা প্রশাসক কিংবা উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তবে মিরপুর মনিপুর স্কুলের চিত্র ভিন্ন। এখানে এখনো আগের কমিটির লোকজনই ঘুরেফিরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে নানাভাবে ফন্দিফিকির করছেন। তবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দাবি আগের কমিটির চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ এবং আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িতদের যেন আগামীতে কমিটিতে না আসতে পারেন সেই ব্যবস্থাও নিতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও বছরে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার বেশি আয়ের এই প্রতিষ্ঠানটিই যেন এক ‘সোনার ডিম’, যার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া একটি স্বার্থান্বেষী চক্র। অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সাবেক সভাপতি তাহমিনা আক্তার এবং অভিভাবক প্রতিনিধি শাকিল মোল্লার নেতৃত্বে থাকা একটি সিন্ডিকেট গত কয়েক মাস ধরে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে।

স্কুলের আর্থিক বিষয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যালয়ের মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে এই চক্রটি একাধিক ভয়ঙ্কর কৌশল অবলম্বন করেছে। এখানে কর্মরত অনেক শিক্ষকও এই অনিয়মের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কেননা সিনিয়র শিক্ষকদের বিএড স্কেলের নামে ঘুষবাণিজ্য যেন অনেকটা নিয়মেই পরিণত হয়েছে মনিপুর স্কুলে। শিক্ষকদের প্রাপ্য অধিকার (যেমন : বিএড স্কেল, উচ্চতর গ্রেড) প্রদানের নাম করে এই চক্রটি প্রত্যকে শিক্ষকের কাছ থেকে গড়ে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ হিসেবে হাতিয়ে নিয়েছে। শিক্ষকদের বদলি বা এক শাখা থেকে অন্য শাখায় স্থানান্তরের জন্যও দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে কমিটির সভাপতি তাহমিনা আক্তার গোপনে প্রায় ২০টি পদে শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বজনদের এবং মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লোক নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। অভিভাবক মহলে প্রতিবাদ উঠলে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। যদিও এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন স্কুলের অভিভাবক প্রতিনিধি শাকিল মোল্লা। এই শাকিল মোল্লার নেতৃত্বে এখানে গড়ে ওঠে একটি শক্তিশালী টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট। তারা পরীক্ষার খাতা ও কাগজ কেনার মতো গুরুত্বপূর্ণ টেন্ডার প্রক্রিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে সিন্ডিকেট করে বিদ্যালয়কে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দেন। ৪০ লাখ টাকার কাগজ কেনার দরপত্র ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা চাওয়া হয়, যা পরে ১ কোটি টাকায় নামানো হয়। অর্থাৎ দরপত্র থেকে ৬০ লাখ টাকা কমিয়ে এনেও আরো অতিরিক্ত আরো ৬০ লাখ টাকা বেশি দিয়ে কেনা হয়েছে কাগজ। আবার এই চক্রটি পুরনো মালামাল বিক্রিতে ৪৪ লাখ টাকা লোপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্কুলের পুরনো মালামাল ৫৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হলেও প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা দেয়া হয় মাত্র ১১ লাখ টাকা। টেন্ডার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে অভিভাবক প্রতিনিধি শাকিল মোল্লা শিক্ষক প্রতিনিধিকে না জানিয়েই একাই মালামাল বিক্রি করে অন্তত ৪৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে সব মহলে অভিযোগ রয়েছে।

আবার একটি সফটওয়্যার কোম্পানিসহ অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাওনা বিল ছাড় করার জন্য সভাপতি ও অভিভাবক প্রতিনিধি চেকের মাধ্যমে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ লাখ করে মোট ২০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। বিল আটকে দেয়ার হুমকি দিয়ে তারা এই অর্থ আদায় করেন। অনেক শিক্ষককে তারা আওয়ামী ট্যাগ দিয়ে চাকরিচ্যুত করারও হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় কিংবা তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার কৌশল নিয়েছেন। অভিভাবক প্রতিনিধি সন্ধ্যার পর শিক্ষকদের বিভিন্ন অজুহাতে তার বাসায় যেতে বাধ্য করেন। একজন শিক্ষক ‘আ’ আদ্যাক্ষরের জানান, বাধ্য না হলে তাকে রাজনৈতিক ট্যাগ (যেমন : আওয়ামী লীগ বা জামায়াত) দিয়ে হয়রানি করা হবে বলে হুমকি দেয়া হতো।

অপর দিকে অভিভাবক প্রতিনিধি শাকিল মোল্লার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, তিনি তার রাজনৈতিক পরিচয় (মিরপুর থানা যুবদলের আহ্বায়ক) ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি অভিভাবক পদ ব্যবহার করে চলেছেন। এই নেতা দলটির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত তথা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, যা বিএনপির ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করছে। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন ভয়াবহ লুটপাট ও নৈরাজ্যের ঘটনায় অভিভাবক ও সচেতন মহল অবিলম্বে একটি গোপন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জোর দাবি জানিয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট যুবদল নেতার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজকে এই দখল ও নৈরাজ্য থেকে মুক্ত করার জন্য সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এসব অভিযোগের বিষয়ে সাবেক সভাপতি তাহমিনা আক্তার ও অভিভাবক প্রতিনিধি শাকিল মোল্লার সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো কথা বলেননি। পরে তাদের দুইজনকেই ক্ষুদে বার্তা দেয়া হলেও এরও কোনো উত্তর তারা দেননি।