ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৮ বছর আজ

ঝুঁকি এড়ানোর বাঁধই ঝুঁকিতে ৩ চরে নেই সুরক্ষা বাঁধ

রবিন আহম্মেদ, পায়রা বন্দর (পটুয়াখালী)
Printed Edition
ঝুঁকি এড়ানোর বাঁধই ঝুঁকিতে ৩ চরে নেই সুরক্ষা বাঁধ
ঝুঁকি এড়ানোর বাঁধই ঝুঁকিতে ৩ চরে নেই সুরক্ষা বাঁধ

ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৮ বছর আজ। কিন্তু দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার তিনটি দুর্গম চরে (চরনজির, চরকাশেম ও চরহেয়ার) এখনো নেই সুরক্ষা বাঁধ। সাগর ও নদীর জোয়ারে পানি বাড়লেই এসব চরের ঘরবাড়ি, ফসল ও গবাদিপশুর জীবন বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। এ কারণে প্রতি বছর নতুন আতঙ্কে দিন কাটে চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল উপকূলের দুর্বলতা কতো ভয়াবহ। অথচ দেড় যুগ পার হলেও রাঙ্গাবালীর সুরক্ষা কাঠামোয় আসেনি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। শুধু উল্লেখিত তিনটি চরই নয়, যেখানে বাঁধ আছে সেই এলাকাগুলোর অবস্থাও বেহাল। অনেক জায়গায় বাঁধের উচ্চতা কমে দুই থেকে তিন মিটারে নেমেছে। কোথাও আবার সম্পূর্ণ বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। ফলে পুরো রাঙ্গাবালীই এখন দুর্যোগে অরক্ষিত এক দ্বীপে পরিণত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, ১৯৮৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ধাপে ধাপে ছয় ইউনিয়নে ১৮৭ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। উচ্চতা ছিল ৩ থেকে সাড়ে ৪ মিটার। কিন্তু সময়ের সাথে ভাঙন আর দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্কারের ফলে সেসব বাঁধের উচ্চতা ও স্থায়িত্ব কমে গেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বউবাজার, নয়ারচর, মিটারবাজার, চরআণ্ডা এবং মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা ও চরলতা, এসব চরের সুরক্ষা বাঁধগুলো নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নতুন করে যেসব বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে সেগুলোও টেকসই নয়। এক-দুই বছরের মধ্যেই আবার ভেঙে যায়। ফলে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তবে সুবিধা পান না মানুষ।

পাউবোর হিসেব অনুযায়ী, চালিতাবুনিয়ার মধ্য চালিতাবুনিয়া ও চরলতা এলাকায় তিন দশমিক পাঁচ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে, আরো দুই কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। চরমোন্তাজের চরআণ্ডায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত, মিটারবাজার সংলগ্ন দুই কিলোমিটার এবং আড়াই কিলোমিটার অংশ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে।

আগুনমুখা ও ডিগ্রি নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বিবির হাওলা গ্রামের শাজাহান প্যাদা বলেন, বাঁধ ভাঙা থাকায় জোয়ার এলে হু হু করে পানি ঢোকে। বাড়িঘর, পশুপাখি প্লাবিত হয়ে যায়। আমরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি। মধ্য চালিতাবুনিয়ার ওমরসানি বলেন, প্রতি বছরই বাঁধ মেরামত করা হয়, কিন্তু টেকে না। টাকা ব্যয় হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। পরিকল্পিতভাবে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করলেই শুধু আমরা নিরাপদ থাকতে পারি।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলাপাড়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শাহ আলম বলেন, জরুরি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে দ্রুত বাঁধ মেরামতের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে রাঙ্গাবালীর চালিতাবুনিয়া ও চরমোন্তাজের মতো ভাঙনকবলিত এলাকায় টেকসই ব্লক বাঁধ নির্মাণে প্রয়োজন ‘হাজার হাজার কোটি টাকা’। এজন্য বড় একটি প্রকল্প নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে রাঙ্গাবালীর কিছু বাঁধ ৭ থেকে সাড়ে ৭ মিটার উচ্চতায় নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা বর্তমানে প্ল্যানিং পর্যায়ে আছে।

জলবায়ু গবেষক ড. মো: শাহরিয়ার জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আরো তীব্র। সিডরের সময় প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। অথচ এত বছর পরও অনেক এলাকায় কোনো বাঁধ নির্মাণ হয়নি, এটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। তিনি আরো বলেন, ৭০-এর দশকে নির্মিত বাঁধগুলো আজ দুর্বল ও নাজুক। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, কিন্তু বাঁধের উচ্চতা বাড়ছে না। তাই ব্লক বাঁধ এবং উচ্চতা বাড়িয়ে টেকসই সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়াই এখন সময়ের দাবি।

তিনি সতর্ক করে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে আতঙ্ক আর নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর শঙ্কায় উপকূলের মানুষের জীবন থমকে আছে। টেকসই বেড়িবাঁধ শুধু দাবিই নয়- এটা উপকূলবাসীর বেঁচে থাকার প্রশ্ন।