রাজস্ব চাপে বিপজ্জনক মোড়- ঋণসেবায় ব্যয় উল্লম্ফন, উন্নয়নব্যয়ে ব্যাপক ধীরগতি

২০২৫ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব

দেশের আর্থিক অবস্থার সর্বশেষ মাসিক বিশ্লেষণে (অর্থবছর ’২৫, জুন পর্যন্ত) পরিষ্কার হয়েছে- সরকারের ব্যয়ের কাঠামো এক অস্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতার দিকে ঝুঁকছে। অপারেটিং খাতে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু অগ্রাধিকার সেক্টরগুলোতে ব্যয়নির্ভরতা কমছে। আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক- সুদের ব্যয় ১১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা পুরো অর্থনীতির ওপর অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি করছে। বিগত অর্থবছরের এই চূড়ান্ত হিসাবে প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয় সবেমাত্র প্রকাশ করেছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

সেক্টও অব’২৪ প্রকৃত (শতাংশ) অব ’২৫ সংশোধিত (শতাংশ) পরিবর্তন

প্রশাসন ৩৫.৩ ৪২.৫ বৃদ্ধি

সামাজিক অবকাঠামো ২৫.৫ ২৪.৯ কমেছে

কৃষি ৮.২ ৫.৪ তীব্র কমেছে

সুদের অর্থ প্রদান ২৭.৮ ২৪.০ (কাগজে কম,বাস্তবেবেশি)

দেশের আর্থিক অবস্থার সর্বশেষ মাসিক বিশ্লেষণে (অর্থবছর ’২৫, জুন পর্যন্ত) পরিষ্কার হয়েছে- সরকারের ব্যয়ের কাঠামো এক অস্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতার দিকে ঝুঁকছে। অপারেটিং খাতে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু অগ্রাধিকার সেক্টরগুলোতে ব্যয়নির্ভরতা কমছে। আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক- সুদের ব্যয় ১১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা পুরো অর্থনীতির ওপর অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি করছে। বিগত অর্থবছরের এই চূড়ান্ত হিসাবে প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয় সবেমাত্র প্রকাশ করেছে।

নতুন প্রতিবেদন বলছে:

  • অপারেটিং ব্যয় (অর্থবছর ’২৫ জুন পর্যন্ত) বাস্তবায়ন ৯৩.৭ শতাংশ
  • উন্নয়নব্যয় বাস্তবায়ন মাত্র ৬৫.৫৩ শতাংশ
  • সুদ পরিশোধ ব্যয় ১৩৪,৪৩০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেটের ১১০.৬ শতাংশ)
  • স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো, সবক্ষেত্রে ব্যয় লক্ষ্যমান থেকে পিছিয়ে

এই চিত্র অর্থনীতির ভঙ্গুরতা ও রাজস্বব্যবস্থার গভীর সঙ্কটকে সামনে এনে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন- এভাবে চললে অর্থবছর-২৬ এর বাজেট আরো বড় ঘাটতির মুখে পড়তে পারে, যা রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যয় কমানো, আর্থিক শৃঙ্খলা জোরদার না করলে টেকসই হবে না।

অপারেটিং ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতা : প্রশাসন বড় খরচ খাত, সেবা উপেক্ষিত

সরকারি পরিচালনা ব্যয় ১৪টি সেক্টরে ভাগ করা হলেও অর্থবছর ’২৫-এ একাধিক সেক্টর অস্বাভাবিক নিম্ন-ব্যয় দেখিয়েছে। এতে পরিষ্কার যে- সার্ভিস ডেলিভারি খাতে বরাদ্দ থাকলেও অর্থ সফলভাবে খরচ হচ্ছে না।

যেসব খাতে ভয়াবহ নিম্ন ব্যয়- ফুয়েল অ্যান্ড এনার্জি: ৭৪ শতাংশ; ইন্ডাস্ট্রিজ-জুট-টেক্সটাইল: ৭৭ শতাংশ; স্বাস্থ্য: ৮৩ শতাংশ; পরিবহন ও যোগাযোগ: ৮৪ শতাংশ; সামাজিক সুরক্ষা: ৮৪.৮ শতাংশ; জেনারেল পাবলিক সার্ভিস: ৮৪.৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলোই সেই খাত যেগুলো অর্থনীতির উৎপাদনশীল ভিত্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যয় সঙ্কোচন দেখাচ্ছে প্রশাসনিক ত্রুটি, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা এবং বাস্তবায়ন সক্ষমতার ঘাটতি।

অন্যদিকে অতিরিক্ত ব্যয় কোথায়- সুদ পরিশোধ: ১১০.৬ শতাংশ (সবচেয়ে বেশি); কৃষি: ৯৬.৬ শতাংশ; ডিফেন্স: ৯৫.৮ শতাংশ এবং পাবলিক অর্ডার অ্যান্ড সেফটি: ৯৪.৯ শতাংশ ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন- সুদ-পরিশোধের পরিমাণ আমদানিনির্ভর অর্থনীতি, দুর্বল রিজার্ভ, অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ ও বৈদেশিক ঋণের মূল্যস্ফীতি ব্যয়ের প্রভাবে দ্রুত বাড়ছে। এই ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে অপারেটিং বাজেটের বড় অংশই ‘অ-উৎপাদনশীল বাধ্যতামূলক ব্যয়’-এ চলে যাবে।

সুদ পরিশোধে ‘ফিসকাল স্পেস’ সঙ্কুচিত- ব্যয়ের ২৮ শতাংশ চলে যাচ্ছে ঋণসেবায়

চলতি অর্থবছরে অপারেটিং খাতের মোট ব্যয়ের ২৮ শতাংশ শুধু সুদ-পরিশোধে- যা অর্থবছর ২৪-এর তুলনায়ও বেড়েছে।

এটি কেন বিপজ্জনক?

১. সরকার উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ক্ষমতা হারায়

২. রাজস্ব সংগ্রহ দুর্বল হলে ঘাটতি পূরণে আবার ঋণ বাড়ে

৩. এর চক্রবৃদ্ধি প্রভাব মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায়

৪. ভবিষ্যৎ বাজেট আরো কঠোর শর্তের মুখে পড়ে

বাংলাদেশ এখন এমন অবস্থায়, যেখানে স্বাস্থ্য-শিক্ষার যৌথ ব্যয়ের চেয়েও বেশি টাকা যাচ্ছে শুধু ঋণের সুদ পরিশোধে।

প্রশাসন ফুলে-ফেঁপে, সামাজিক অবকাঠামো সঙ্কুচিত

ঋণ ’২৫-এর সংশোধিত বাজেটে দেখা যাচ্ছে:

প্রশাসনিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি- সরকারের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়া, বেতন-ভাতা, নিরাপত্তা খাতের ব্যয় উল্লম্ফন এবং রাজনৈতিক ট্রানজিশনের খরচের প্রতিফলন।

উন্নয়ন বাজেট : বাস্তবায়নে ধস- মোট ব্যয়ের মাত্র ৬৫ শতাংশ খরচ : উন্নয়নব্যয় বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে। অব ’২৫ (জুন পর্যন্ত) বাস্তবায়ন: ৬৫.৫৩ শতাংশ, অব ’২৪ একই সময়ে বাস্তবায়ন ছিল ৮০.৪২ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ পয়েন্টের পতন।

এটি নির্দেশ করে : প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থবির; আমদানি নির্ভর প্রকল্পগুলোতে দেরি; বিদেশী ঋণনির্ভর প্রকল্পে ডলার সঙ্কটে বিলম্ব; অনেক মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ধীরগতিতে।

যেসব সেক্টরে ব্যয় বেশি হয়েছে- ফুয়েল অ্যান্ড এনার্জি: ১০২.৫ শতাংশ; ডিফেন্স: ৯৫.৬ শতাংশ; অ্যাগ্রি-ফিশারিজ-লাইভস্টক: ৯০.৬৩ শতাংশ; এলজিআরডি: ৮৩.৮১ শতাংশ; শিক্ষা: ৬৯.৭৪ শতাংশ।

যেসব সেক্টরে ব্যয় অত্যন্ত কম- স্বাস্থ্য : মাত্র ৩০.২৮ শতাংশ; আইইএস: ৬৪ শতাংশ; এইচসিএস: ৬৪.৫ শতাংশ; পাবলিক অর্ডার অ্যান্ড সেফটি: ৬৩.৯৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে বাস্তবায়নের এই ভয়াবহ নি¤œ হার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপের সময় উদ্বেগজনক।

কী সঙ্কট ফুটে উঠছে-অভ্যন্তরীণ তদন্তযোগ্য পাঁচটি লাল সঙ্কেত

১. ঋণ-পরিষেবার ফাঁদ: সুদ পরিশোধে অস্বাভাবিক উল্লম্ফন: সংশোধিত বাজেট ছাপিয়ে সুদ পরিশোধ- রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনার সতর্কসঙ্কেত। এটি দেখায় রাজস্ব-ঋণ ভারসাম্য বিপর্যয়ের দিকে।

২. সামাজিক সেক্টর ব্যয়ে সঙ্কোচন : স্বাস্থ্য-শিক্ষায় ব্যয় লক্ষ্যমাত্রার নিচে থাকা জনগণের মৌলিক সেবায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. উন্নয়ন প্রকল্পে অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জট: বিশেষ করে সড়ক-যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও আবাসন খাতে।

৪. প্রশাসনিক ব্যয় ফুলে-ফেঁপে ওঠা: এটি দেখায়- রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরেও বেতন-ভাতা-প্রশাসনিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি।

৫. আইইএস (শিল্প-বাণিজ্য) খাতে ব্যয় কম: উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমে যাওয়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে আরো ধীর করবে।

ফিসকাল স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে- নীতিগত পুনর্গঠন জরুরি

ডাটা থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের রাজস্ব-ব্যয় কাঠামো এখন তিনটি বড় চাপের মুখে- ১. উচ্চ সুদ পরিশোধ; ২. নিম্ন উন্নয়ন ব্যয় এবং ৩. মানবসম্পদ ও সেবা খাতে ব্যয় সঙ্কোচন।