মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আমিন-স্বপন ও নূর আলী গংরা ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির সমন্বয়ে সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠিয়ে যেখানে হাঁফিয়ে উঠেছেন সেখানে লেবাননের শ্রমবাজারটি মধু ওভারসিজ নামে একটি এজেন্সির মালিক একাই দীর্ঘদিন ধরে তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে।
অভিবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কর্মীর বিপরীতে সত্যায়ন করানোর নামে মধু ওভারসিজের মালিক কোটি কোটি টাকা কর্মীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন। তারা মধু সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়ে বলছেন, লেবাননে সত্যায়িত-অসত্যায়িত যেভাবেই হোক সবাইকে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিতে। এমন দাবি জানিয়ে সম্মিলিত সমন্বয় ফ্রন্টের ব্যানারে বায়রা সদস্যরা সোচ্চার হয়েছেন। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগে সৌদি আরব, লেবাননসহ অন্যান্য দেশে কর্মী প্রেরণে সত্যায়ন প্রথা (১ থেকে ২০ জন কর্মীর ক্ষেত্রে) তোলার পাশাপাশি ওয়ানস্টপে ছাড়পত্র দেয়ার দাবি জানান। একই সাথে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে থাকা সত্যায়ন সমস্যা থেকে উত্তরণে সমাধানের পথও তুলে ধরা হয়।
এ দিকে ভুক্তভোগী রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা লেবাননে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অভিবাসন আইনে বিএমইটির কর্মকর্তারা ওয়ান স্টপ সার্ভিসে জমা পড়া অসত্যায়িত ভিসায় বিদেশগামীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়ার নিয়ম থাকলেও তাতেও বাদ সাধছে একক ভিসায় কর্মী পাঠানো সিন্ডিকেটটি।
গত ২৮ মে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়ার কাছে বায়রা সম্মিলিত সমন্বয় ফ্রন্টের পক্ষে সাবেক সংসদ সদস্য ও বায়রা সভাপতি ও সিলভার লাইন অ্যাসোসিয়েট (আর-এল-০০০৮) স্বত্বাধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ এইচ সেলিম লিখিত অভিযোগ দেন।
বিএমইটির বিদ্যমান সমস্যা ও তার সমাধান বিষয়ে তিনি বলেন, সৌদি আরবে বছরে প্রায় ৬ লাখের অধিক কর্মী গিয়ে থাকে, তার মধ্যে শতকরা মাত্র ৩.৫% ভিসা/ডিমান্ড সত্যায়ন হয়। তা ছাড়া বিদ্যমান জনবল দিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষে সব নিয়োগকর্তার কর্মস্থল পরিদর্শন করে এত সংখ্যক ভিসা সত্যায়ন করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখের অধিক কর্মী সৌদি আরবে কর্মরত। সত্যায়ন ঝামেলার কারণে এই শ্রমবাজারটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানের দিকে চলে যাচ্ছে। তাই বিষয়টির সমাধান জরুরি উল্লেখ করে এম এ এইচ সেলিম কিছু সমাধান ওই চিঠিতে তুলে ধরেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সমাধানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১-২০ পর্যন্ত সৌদি ভিসা সত্যায়নের বাইরে রাখা, যেসব ভিসা প্রফেশনাল (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, আইটি) তাদের ভিসা গ্রুপের মধ্যে পড়ে গেলেও সত্যায়ন লাগবে না, সৌদি দূতাবাসের সাথে বিএমইটির রেইমসের (আরএইএমএস) সাথে অনলাইন ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা, অন্যান্য দেশের ভিসা অনলাইনে পাওয়া গেলে সত্যায়নবহির্ভূত রাখা, যেসব ভিসা পাসপোর্ট এ স্ট্যাম্পিং হয় সেগুলো সত্যায়নবহির্ভূত রাখা এবং লেবাননের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করা ও অন্যান্য এজেন্সিকে অ্যাম্বাসিতে এনলিস্টমেন্ট করা। সচিবের কাছে দেয়া অভিযোগে সাবেক বায়রা সভাপতি আরো উল্লেখ করেন, বর্তমানে ভিসাগুলো মধু ওভারসিস ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১২২৩) মাধ্যমে সব ভিসা সত্যায়ন করা হয়। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আইনে ডিমান্ড লেটার সত্যায়নের কথা বলা আছে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত ভিসা সত্যায়নের বাইরে রাখা ও ওয়ান স্টপে বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স দেয়ার ব্যবস্থা করার কথা ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, মেসার্স মধু ওভারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক হচ্ছেন মো: মোতাহের হোসেন। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বৈধভাবে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে ৩৩ হাজার ৯৯৬ জন কর্মী বিদেশে গেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লেবাননে কর্মী গেছে ২০৪৮ জন। তার মধ্যে ২০২৫ সালের ১ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত কর্মী গেছে ৬০৯ জন (পুরুষ-মহিলা)। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মধু ওভারসিসের মাধ্যমে কর্মী গেছে ১৫৩৬ জন।
গতকাল সন্ধ্যায় কাকরাইলের একটি জনশক্তি প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নয়া দিগন্তকে নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, মধু ওভারসিসের মালিক মোতাহের হোসেন লেবাননে কর্মী পাঠানোর জন্য বিএমইটি থেকে যে ৬০৯ জনের বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়েছেন তার মধ্যে ৪০০ জনই সেলফে (ওয়ানস্টপে) গেছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মালয়েশিয়াতে তো সিন্ডিকেট হয়েছে ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। আর লেবাননের পুরো শ্রমবাজার সিন্ডিকেট করে রেখেছেন মধু ওভারসিসের মালিক একাই এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। অথচ আইনে বলা আছে অসত্যায়িত ভিসায় বিএমইটির কর্মকর্তারা দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়াই যাচাই-বাছাই করে ছাড়পত্র দিতে পারবেন। এতেও তিনি বাধা দিচ্ছেন। বিএমইটির অফিসারদের ওপর চাপ দিচ্ছেন। অথচ আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, দূতাবাস থেকে তিনি যে সত্যায়ন করিয়ে আনছেন তাতে একজন কর্মীর বিপরীতে বহির্গমন ছাড়পত্র করানো বাবদ কখনো ৩০ হাজার টাকা আবার কখনো ৩৫ হাজার টাকাও নিয়েছেন। এভাবে হিসাব করলে কোটি কোটি টাকা তিনি ছাড়পত্র করানোর নামে কর্মীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। অথচ আমাদের কর্মীদের পাসপোর্ট ভিসা সবই ঠিক থাকার পরও বিএমইটির ওয়ানস্টপ থেকে ছাড়পত্র পাচ্ছি না।