- উদ্যোগ নিতে অর্থ উপদেষ্টার কাছে গভর্নরের চিঠি
- খসড়া অধ্যাদেশে মামলা নিষ্পত্তিতে প্রশিক্ষিত বিচারক নিয়োগ
- ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি
- খেলাপিদের এনআইডি, পাসপোর্ট, নির্বাচনের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা আরোপের প্রস্তাব
তিন কারণে ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ-২০২৫’ দ্রুত অনুমোদন করে তা অধ্যাদেশ আকারের জারি করার অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের খেলাপি/শ্রেণীকৃত ঋণ আদায় ত্বরান্বিতকরণ এবং ঋণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম রীতি যথাসম্ভব বিবেচনায় নিয়ে অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এই খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘অভিজ্ঞ অথবা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিচারকদের একটি পুল থেকে বিচারক নিয়োগ করা হবে এবং গঠন করা হবে অর্থঋণ আপিল আদালত, যা উচ্চ আদালতের সমপর্যায়ে হবে। একই সাথে অর্থঋণ মামলা ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং খেলাপিদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং কোম্পানি পরিচালনা পদে থাকার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে এই অধ্যাদেশে।
এই পর্যায়ে গভর্নর বলেছেন, এখন তিন কারণে এই অধ্যাদেশ দ্রুত অনুমোদন করে জারি করা প্রয়োজন। এই কারণের মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেন- এই অধ্যাদেশ জারি করা হলে এক. খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করার সময়সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে, দুই. নির্বাহী সহায়তার মাধ্যমে প্রয়োগ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে এবং তিন. আর্থিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার সামগ্রিক দক্ষতা ও সুশাসন বৃদ্ধি পাবে।
সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের কাছে তিনি দ্রুত অধ্যাদেশ জারির অনুরোধ করে একটি চিঠি (আধা-সরকারি) প্রেরণ করেছেন। অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গভর্নর তার পত্রে বলেছেন, খসড়া অধ্যাদেশে মোট ২০টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যা কি না খেলাপি ঋণ আদায় দ্রুততর ও বন্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই বিষয়াদির মধ্যে রয়েছে-
১. আদালতের কাঠামো : এ বিষয়ে গভর্নর তার পত্রে বলেছেন, খসড়া অধ্যাদেশে ‘অভিজ্ঞ অথবা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিচারকদের একটি পুল থেকে বিচারক নিয়োগের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থঋণ আপিল আদালত নামে একটি আপিল আদালত গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা উচ্চ আদালত সমপর্যায়ের এখতিয়ার ভোগ করবে।’
২. মামলা-পূর্ব নিষ্পত্তি : অধ্যাদেশে ‘মামলা দায়েরের পূর্বে জামানতকৃত সম্পদ বিক্রয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বিকল্প-বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে এবং আদালতে মামলার চাপ হ্রাস করবে।’
৩. মামলা-পূর্ব বিক্রয় : জামানতকৃত সম্পদের দখল, সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ এবং বিভিন্ন বিক্রয় পদ্ধতি যেমন- কোটেশন, ব্যক্তিগত আলোচনা, দরপত্র বা নিলাম সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুক ভ্যালুতে জামানতকৃত সম্পদ অধিগ্রহণের অনুমতি প্রদানের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৪. বাদিপত্রের (প্লাইন্ট) শর্তাবলি : প্রত্যেক বাদিপত্রে জামানতকৃত ও জামানতকৃত নয় এরূপ সম্পদের বিস্তারিত তালিকা এবং ঋণগ্রহীতা ও সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ সংযুক্ত রাখার বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে।
৫. সমন জারির বিধান : গভর্নর বলেছেন, ‘মামলার সমন রেজিস্টার্ড ডাকযোগে প্রেরণ এবং অন্তত দুইটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের মাধ্যমে জারি করার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।’
৬. লিখিত জবাব : সমন প্রাপ্তির তারিখ থেকে ত্রিশ (৩০) দিনের মধ্যে বিবাদিকে লিখিত জবাব দাখিল করার বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ পনের (১৫) দিন অতিরিক্ত সময় দেওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এর জন্য বাদিপত্রের দাবিকৃত অর্থের ০.৫% অথবা এক লক্ষ (১,০০,০০০) টাকা-যেটি অধিক-পরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে প্রদান করতে হবে।
৭. মুলতবি : মামলা সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি মুলতবি করা যাবে না। প্রতিবার মুলতবির জন্য বাদিপত্রের দাবিকৃত অর্থের ০.৫% বা এক লক্ষ (১,০০,০০০) টাকা, যেটি অধিক, সেই পরিমাণ অর্থ জরিমানা প্রদান করতে হবে।
৮. মামলা নিষ্পত্তি : অর্থঋণ মামলা নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ কারণে ত্রিশ (৩০) দিন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। নির্ধারিত সময়সীমা ভঙ্গ হলে আপিলের সুযোগ থাকবে।
৯. একতরফা ডিক্রি : খসড়া অধ্যাদেশে ‘একতরফা ডিক্রি বাতিলের আবেদন করার ক্ষেত্রে জামানত জমার হার ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
১০. হলফনামা সাক্ষ্য : হলফনামাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণের বিধান বহাল থাকবে : পূর্বে হলফনামা দাখিল করা হলে মৌখিক সাক্ষ্য ঐচ্ছিক হওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
১১. কার্যকরী প্রক্রিয়া : রিকভারি সার্টিফিকেট পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, কার্যকর প্রক্রিয়া পরিচালনা করবেন রিকভারি অফিসার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট), যা প্রচলিত আদালতের প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কার্যকর হবে।
১২. কার্যকরীকরণ সময়সীমা : একাধিক কার্যকর মামলা দায়েরের প্রথা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সম্পূর্ণ কার্যকরীকরণ প্রক্রিয়া নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে, প্রয়োজনে ষাট (৬০) দিন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৩. পুনরুদ্ধারের পদ্ধতি : সম্পদ বিক্রয়, ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, ঋণ-ইকুইটি রূপান্তর এবং সরকারের নির্ধারিত অন্যান্য পদ্ধতিসহ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্র সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৪. বিক্রয় কার্যক্রম : সংরক্ষিত মূল্য (রিজার্ভ প্রাইস) নির্ধারণ, ১০% পুনর্নির্ধারণ প্রক্রিয়া এবং নিলাম ব্যর্থ হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ফেসভ্যালু বা প্রথম সংরক্ষিত মূল্যে সম্পদ হস্তান্তরের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
১৫. সম্পদ অনুসন্ধান : খসড়া অধ্যাদেশে ‘দেশের অভ্যন্তরে বা দেশের বাইরে অর্থ অপব্যবহার, সম্পদ স্থানান্তর বা সংশ্লিষ্ট পক্ষের নামে অর্জিত সম্পদ চিহ্নিত ও পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা প্রদান করার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৬. দাবির অগ্রাধিকার : জামানতদার ঋণদাতাগণকে অন্যান্য ঋণদাতা, সরকারি পাওনা এবং জব্দকৃত সম্পদের ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৭. অন্তর্বর্তী আদেশ : মামলা দায়েরের পূর্বে আদালত কর্তৃক অন্তর্বর্তী আদেশ (যেমন- নিষেধাজ্ঞা, রিসিভার নিয়োগ, সম্পদ জব্দ, তথ্য প্রকাশের নির্দেশ বা দেওয়ানি আটকাদেশ) প্রদান করার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৮. খেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা : জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং কোম্পানি পরিচালনা পদে থাকার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৯. দেওয়ানি আটকাদেশ : সর্বোচ্চ আটকাদেশের মেয়াদ ছয় (৬) মাস থেকে এক (১) বছরে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০. একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ ও সংযুক্তি : খসড়া অধ্যাদেশে একীভূত প্রতিষ্ঠানের সব মালিকানা, অধিকার ও স্বার্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।
গভর্নর তার পত্রে প্রস্তাবিত সংশোধনীর প্রত্যাশিত ফলাফলে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করার সময়সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে নির্বাহী সহায়তার মাধ্যমে প্রয়োগ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। এবং আর্থিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার সামগ্রিক দক্ষতা ও সুশাসন বৃদ্ধি পাবে।
গভর্নর মনসুর তার পত্রে বলেছেন, উল্লিখিত পরিবর্তনগুলো ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঋণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় এবং শ্রেণীকৃত ঋণ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে মর্মে আশা করা যায়।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লিখিত অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করত: তা জারি করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থ উপদেষ্টাকে অনুরোধও করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক সূত্র জানায়, চলতি মাসেই অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হতে পারে। অনুমোদিত হলে তা দ্রুতই অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে।



