খালেদা জিয়া নামে অমর, কাজেও

খালেদা জিয়া ছিলেন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী এক মহীয়সী নারী, যিনি নিখাদ এক গৃহবধূ থেকে ধূমকেতুর মতো রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়ে জাতির ধ্রুবতারায় পরিণত হয়েছিলেন। অন্ধকারে যেমন দিকহারা মানুষ ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে দিশা খুঁজে পায়, তেমনি খালেদা জিয়ার চিন্তাধারা দেখেও জাতি দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সঠিক পথের নিশানা খুঁজে পেত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রমাণ করে গেছেন। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে ‘মওতুল আলেমে মওতুল আলম’ অর্থাৎ পথপ্রদর্শকতুল্য কারো মৃত্যু মানে একটি জাহানের মৃত্যু। খালেদা জিয়ার মৃত্যু সেই প্রবাদের সত্যায়ন করে।

সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর
Printed Edition

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন-সার্বভৌম মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষের মতো আমরা নয়া দিগন্ত পরিবারও দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, তিন তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী, দেশনেত্রী, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মমতাময়ী আম্মা এবং দেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে অত্যন্ত শোক, দুঃখ ও বেদনাহত। এমন এক অস্থির সময়ে তিনি দুনিয়ার সফর শেষ করলেন যখন সমগ্র জাতিকে বিপদে সাহস জোগানো আর দুঃখে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তার মতো এক অভিভাবকের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল অত্যন্ত বেশি। ফলে তার চিরবিদায়ে পুরো দেশ ও জাতি অভিভাবকহীন ও অসহায় হয়ে পড়ল।

খালেদা জিয়া ছিলেন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী এক মহীয়সী নারী, যিনি নিখাদ এক গৃহবধূ থেকে ধূমকেতুর মতো রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়ে জাতির ধ্রুবতারায় পরিণত হয়েছিলেন। অন্ধকারে যেমন দিকহারা মানুষ ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে দিশা খুঁজে পায়, তেমনি খালেদা জিয়ার চিন্তাধারা দেখেও জাতি দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সঠিক পথের নিশানা খুঁজে পেত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রমাণ করে গেছেন। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে ‘মওতুল আলেমে মওতুল আলম’ অর্থাৎ পথপ্রদর্শকতুল্য কারো মৃত্যু মানে একটি জাহানের মৃত্যু। খালেদা জিয়ার মৃত্যু সেই প্রবাদের সত্যায়ন করে।

তবে খালেদা জিয়া এমনি এমনি এই সম্মান, মর্যাদা ও অবস্থান অর্জন করেননি। এ জন্য তাকে যে জেল-জুলুম ত্যাগ-তিতীক্ষা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অপমান-অপদস্থ এবং দেশী-বিদেশী চক্রান্তের নির্মম শিকার হতে হয়েছে, তা স্মরণ করলে তার পর্যায়ে তার মতো দুঃখী মানুষ খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কিন্তু দেশ-জাতি, দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বার্থে তিনি অকাতরে সব দুঃখ সহ্য করেছেন। একটু আপস করলেই তার সামনে যেখানে অবারিত সুযোগ-সুবিধা আর ভোগবিলাসের হাতছানি ছিল, সেখানে তিনি দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাউকে ন্যূনতম ছাড় না দিয়ে দুর্দশার জীবনকেই বেছে নিয়েছেন। তার সম্পর্কে সেই চিরচেনা কথাটিই বলা যায়- ‘এসেছিলে সাথে নিয়ে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’। এ জন্য তিনি জাতির কাছ থেকে পেয়েছেন দুর্লভ অভিধা ‘আপসহীন নেত্রী’।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জনক বলা হয়, সেই জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন- ‘না’ বলতে পারার মধ্যেই মানুষের স্বাধীনতা স্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত হয়, সব কিছুতে ‘হ্যাঁ’ বলা স্বাধীনতার প্রতিফলক নয়। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন এই দর্শনের সফল নমুনা। কোনো বাধা, হুমকি, নির্যাতন নীতিবিরোধী কোনো কিছুতে তাকে হ্যাঁ বলাতে কেউ সক্ষম হয়নি। নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদ যেমন তাকে দমাতে পারেনি, ২০০৭ সালে বিদেশী সেবাদাস মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের জেলজুলুম ও মাইনাস ফর্মুলাকে তেমনি নিকুচি করে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন বাংলাদেশই তার এক ও একমাত্র ঠিকানা; তাই দেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না।

সবশেষ ৩৬ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছর তাকে নাকাল করার কোনো কিছুই কি বাকি ছিল? তাকে জেল-জুলুম, অপবাদ, মিথ্যে মামলা, অন্যায় শাস্তি, স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে অপমান করে এককাপড়ে বের করে দেয়া, বিনা চিকিৎসায় মারার ব্যবস্থা করে তা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মোসাহেবদের নিয়ে অট্টহাসির প্রতিযোগিতা দেয়া, ঠাট্টা-তামাশা করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো কোনো হীনতা বাদ ছিল? এ সময়ে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো, মা তৈয়বা মজুমদার, বড় বোন খুরশীদ জাহান হক (চকলেট আপা) ছোট ভাই সাঈদ এস্কান্দরের মৃত্যুর মতো শোকাবহ ঘটনা কোনোটাই বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ়তাকে এতটুকু ম্লান করতে পারেনি, বরং তিনি অসীম ধৈর্যের সাথে সব কিছু সহ্য করেছেন, কারো বিরুদ্ধে এমনকি জালেমের বিরুদ্ধে কোনো কটূক্তি করেননি, বরং নিজের সভ্যতা-শরাফত, উন্নত জীবনবোধ, উৎকৃষ্ট সংস্কৃতি দিয়ে সবার জন্য শিক্ষণীয় হয়েছেন। তিনি সারাক্ষণ পরওয়ারদিগারের ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’ অমোঘ ঘোষণায় প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনিময় ও রহমতের অপেক্ষা করেছিলেন।

সেই বিনিময় হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এই কুটিল পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। যাকে অপমান করার জন্য পুরো রাষ্ট্র কোমরে গামছা বেঁধে নেমেছিল, সেই রাষ্ট্রকেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা খালেদা জিয়ার সম্মানে নমিত হতে বাধ্য করলেন। পুরো জাহান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখছে কুরআন মজিদের জলদগম্ভীর সেই ঘোষণা কত ধ্রুব সত্য ‘হে আল্লাহ তুমিই ক্ষমতার মালিক, যাকে ইচ্ছে এই ক্ষমতা দাও, আর যার কাছ থেকে ইচ্ছে হয় কেড়ে নাও, যাকে চাও সম্মান দাও আর যাকে ইচ্ছে হয় বেইজ্জত করো, ভালো-মন্দ তোমার হাতে। তুমিই সর্বশক্তিমান।’

জাতির এক যুগসন্ধিক্ষণে ত্রাতা হিসেবে এসেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মানুষের ধারণা ছিল জিয়া ও বিএনপির রাজনীতি বুঝি শেষ, কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া প্রমাণ করলেন সে ধারণা ভুল। তিনি শহীদ জিয়ার সমন্বয় ও ভারসাম্যের রাজনীতিকে শুধু এগিয়ে নিয়ে গেলেন না, বরং একে প্রতিষ্ঠানে রূপ দিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন সমন্বয় ও ভারসাম্যের রাজনীতি ছাড়া দেশ টিকবে না। একজন নিখুঁত গৃহবধূর এই অনুভব সত্যিই বিস্ময়কর ও বিরল। বিএনপির আগামী নেতৃত্বকেও শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির এই চৌহদ্দি থেকে বের হওয়া উচিত হবে না।

বেগম খালেদা জিয়া আজ আমাদের কাছ থেকে আল্লাহর অনিবার্য হুকুমে চিরবিদায় নিচ্ছেন, কিন্তু তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের স্মৃতি ও শিক্ষা তাকে জাতির কাছে চিরজাগরূক রাখবে, ইনশা আল্লাহ। কবির ভাষার- তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহান ‘আর ‘খালেদা’ আরবি শব্দের অর্থই হচ্ছে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী। তিনি তো মরতে পারেন না। তাকে যে নামের সার্থকতার প্রতীক বানানোই সর্বশক্তিমানের দরবারে নির্ধারিত।

আমরা মহান রবের শাহী দরবারে বেগম খালেদা জিয়ার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। তিনি জাতির যে খেদমত করেছেন আল্লাহ তা কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ মর্যাদায় তাকে অভিষিক্ত করুন, আমিন। আমরা তার প্রাণাধিক পুত্র, দেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমান তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমান, তাদের মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমানসহ পরিবারের শোকাহত সবার প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা, কামনা করছি তাদের সফল ও নিরাপদ জীবন।