বিশ্ব অর্থনীতির মন্থর গতি, ভোক্তাব্যয়ের সঙ্কোচন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পুনরুজ্জীবিত শুল্কনীতির চাপ সবকিছু মিলিয়ে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে যখন অনিশ্চয়তা তীব্র, তখনো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক (আরএমজি) রফতানি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আরএমজি রফতানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশের বেশি, যা একই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানির এই প্রবৃদ্ধি কেবল সংখ্যাগত সাফল্য নয়; বরং এর ভেতরে রয়েছে বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিবর্তিত বাস্তবতা, ক্রেতাদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশের পোশাক খাতের কাঠামোগত শক্তি ও সীমাবদ্ধতার এক জটিল মিশ্রণ। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন-পরবর্তী সময়ে শুল্কনীতি আবারো আলোচনায় এসেছে। যদিও বাংলাদেশ সরাসরি অতিরিক্ত শুল্কের লক্ষ্যবস্তু নয়, তবুও বৈশ্বিকভাবে শুল্ক বাড়ানোর প্রবণতা পোশাক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। কাঁচামাল, পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়েছে, যার চাপ শেষ পর্যন্ত সরবরাহকারী দেশগুলোর ওপরই পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় অনেক রফতানিকারক দেশের প্রবৃদ্ধি স্থবির কিংবা ঋণাত্মক হলেও বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা উচ্চমূল্যের ফ্যাশন পণ্য থেকে সরে এসে কমদামি, বেসিক ও বড় পরিসরের অর্ডারের দিকে ঝুঁকছেন যেখানে বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই শক্ত অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব দেশে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, শ্রম খাতে অস্থিরতা এবং মুদ্রা বিনিময় হারের চাপ রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা শুল্ক আরোপ, বৈশ্বিক মন্দাভাব ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক (আরএমজি) রফতানিতে ১৮.৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি একদিকে যেমন আশাব্যঞ্জক, তেমনি এর আড়ালে রয়েছে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী এই প্রবৃদ্ধি প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি হলেও রফতাানিকারক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে সতর্কবার্তাও বহন করছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৬৪২ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০১ কোটি ডলার বেশি। একই সময়ে রফতানির পরিমাণও বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক গড় আমদানি বৃদ্ধির হার ১.৭৪ শতাংশকে অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় আকারের উৎপাদন সক্ষমতা, দীর্ঘদিনের ক্রেতাসরবরাহকারী সম্পর্ক এবং তুলনামূলক কম ইউনিট কস্ট ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে টি-শার্ট, ট্রাউজার, ডেনিম ও বেসিক নিটওয়্যার পণ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছে এখনো সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক উৎস হিসেবে বিবেচিত।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সালের আগস্ট থেকে টানা চার মাস ধরে সামগ্রিক আরএমজি রফতানিতে নি¤œমুখী প্রবণতা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আপাত প্রবৃদ্ধি থাকলেও সামগ্রিক রফতানি পরিস্থিতি চাপের মধ্যে রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ পোশাক রফতানিকারকের অবস্থান ধরে রেখেছে, যদিও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে, উচ্চ শুল্ক ও ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে চীনের রফতানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করলেও একই সাথে নতুন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রও তৈরি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শেয়ার হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চীন এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে আগ্রাসী কৌশল নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম দামে পোশাক সরবরাহ করে তারা বাজার ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ফলে ইইউ বাজারে বাংলাদেশের জন্য প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যৎ রফতানি প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
একজন শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক জানান, রফতানি বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু মার্জিন আগের তুলনায় অনেক কম। টিকে থাকার জন্যই আমরা অনেক সময় কম দামে কাজ নিতে বাধ্য হচ্ছি। এদিকে উচ্চ সুদের হার, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি এবং কাঁচামাল আমদানিতে ডলারের দামের চাপ উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বড় রিটেইলার ও ব্র্যান্ডগুলো এখন ঝুঁকি ছড়িয়ে দিতে চাইছে। চীন থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে তারা অর্ডার ভাগ করে দিচ্ছে একাধিক দেশে। এই ‘চায়না-প্লাস-ওয়ান’ কৌশলে বাংলাদেশ বড় সুবিধাভোগী হয়েছে। একই সাথে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কারখানার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সবুজ কারখানা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হওয়ায় অর্ডার ধরে রাখতে পারছে।
তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, শুল্কচাপ দীর্ঘমেয়াদে আরো বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিবর্তন, নির্বাচন-পরবর্তী বাণিজ্যনীতি এবং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা পোশাক রফতানিতে নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাদের মতে, কেবল কম দামের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে থাকা টেকসই নয়। পণ্যের বৈচিত্র্য, উচ্চমূল্য সংযোজন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানে জোর না দিলে এই দাপট ধরে রাখা কঠিন হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার অন্যতম শর্ত হলো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নীতিগত স্থিতিশীলতা। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রেতাদের আস্থা বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্ডার আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির কারণে চীন থেকে সরে আসা কার্যাদেশ বাংলাদেশের দিকে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে উৎপাদন দক্ষতা, সময়মতো ডেলিভারি এবং মূল্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা আরো জোরদার করতে হবে। অন্যথায় ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো সেই শূন্যস্থান দখল করে নিতে পারে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কম্বোডিয়া সর্বোচ্চ ২৮.৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, আর ইন্দোনেশিয়া ও ভারতও দ্বি-অঙ্কের প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা ক্রমেই বহুমুখী ও জটিল হয়ে উঠছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের আরএমজি রফতানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি একদিকে শিল্পের সক্ষমতা ও অভিযোজন ক্ষমতার প্রমাণ, অন্যদিকে এটি স্বস্তির চেয়ে সতর্কতার জায়গাই বেশি নির্দেশ করে। শুল্কের প্রকৃত প্রভাব, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ, ইউরোপের বাজারে চীনের আগ্রাসন এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এই চারটি বিষয়ই আগামী মাসগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক খাতের গতিপথ নির্ধারণ করবে বলে তারা মনে করেন।



