পুঁজিবাজারে দরপতনের ধারা অব্যাহত

মন্দায়ও দর বাড়ছে স্বল্প মূলধনী কোম্পানির

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
Printed Edition

পুঁজিবাজারে দরপতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে বড় দরপতনের পর গতকাল মঙ্গলবারও বড় ধরনের পতনের শিকার হয় দেশের দুই পুঁজিবাজার। গতকাল নিয়ে টানা দু’দিনের এ দরপতনের ঘটনা এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে মন্দা বিরাজ করলেও এভাবে সূচকের বড় ধরনের পতন ঘটতে দেখা যায়নি।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল ৩৭ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট হারায়। এর আগে রোববারও সূচকটির ৩৫ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট অবনতি ঘটে। এভাবে দুই কর্মদিবসে সূচকটির ৭৩ পয়েন্টের বেশি হারায় ডিএসই। এ সময় ডিএসইর অপর দুই সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহর অবনতি হয় যথাক্রমে ৩৪ দশমিক ৪৩ ও ১৭ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট।

দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই গতকাল ১০০ দশমিক ১৪ পয়েন্ট হারায়। এখানে সিএসই-৩০ ও সিএসইসএক্স সূচকের অবনতি হয় যথাক্রমে ৯১ দশমিক ৪৫ ও ৫৫ দশমিক ৫২ পয়েন্ট।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বাজারের এ নেতিবাচক আচরণের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে কিছু কিছু সিকিউরিটিজের টানা মূল্যবৃদ্ধি দেখা গেছে। এখন আবার এগুলোতে কিছুটা সংশোধন ঘটছে। লেনদেনের অবস্থাও খুব একটা খারাপ নয়। তারপরও সূচকের এমন অবনতি অপ্রত্যাশিত।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্টকের সাবেক এক পরিচালক নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের অর্থনীতির সব সূচক এখন উন্নতির দিকে। তবে সামনে বাজেট আসছে। বরাবরই বাজেটকে সামনে রেখে পুঁজিবাজারে একটু নেতিবাচক আচরণ দেখা যায়। এটাও এ মুহূর্তে নেতিবাচক আচরণের কারণ হতে পারে।

মঙ্গলবার ডিএসইর ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের বির্ভিন্ন ট্রেডিং ফ্লোর ঘুরে দেখা যায়, বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ধারিত আসনের অধিকাংশই ফাঁকা। যারা উপস্থিত আছেন তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। নয়া দিগন্তকে তারা বলেন, গত বছর দেশে সংঘটিত বড় ধরনের একটি পরিবর্তনের প্রায় এক বছর পার হতে চললেও পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা তার কোনো সুফল পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে, পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির অংশ নয়। এ নিয়ে সরকারেরও কোনো মাথাব্যথা নেই। এখানে সাধারণ ক্ষুদ্র নিয়োগকারীরা যেমন প্রতিদিন নিঃস্ব হচ্ছেন তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রতিনিয়ত সক্ষমতা হারাচ্ছে। আবার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করছে যা বাজারকে স্থিতিশীল হতে দিচ্ছে না। ফলে প্রায় প্রতিদিনই দিনের শুরুতে বাজার থাকছে ঊর্ধ্বমুখী। অথচ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিক্রয়চাপে আক্রান্ত হচ্ছে।

এ দিকে সাম্প্রতিক মন্দা বাজারেও দেশের দুই পুঁজিবাজারেই স্বল্প মূলধনের কোম্পানিগুলোর ঘটছে টানা মূল্যবৃদ্ধি। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের কোম্পানিগুলোর শেয়ার বেশ কিছু দিনের মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। গতকালও উভয় বাজারে এ ব্যতিক্রম ছিল না। দুই বাজারেই মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে উঠে আসে এ ধরনের কয়েকটি কোম্পানি। এর মধ্যে ডিএসইতে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি খাতের একটি কোম্পানি গত টানা পাঁচ কর্মদিবসই মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় লেনদেন হচ্ছিল। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত আরেকটি ইস্পাত ও প্রকৌশল খাতের স্বল্প মূলধনী কোম্পানিও ছিল এ তালিকায়। গতকাল এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি কোম্পানিও। অথচ স্বল্প মূলধনী হওয়ার কারণে দিনের সূচকে তার উল্লেখ করার মতো প্রভাব দেখা যায় না। একইভাবে সিমেন্ট খাতের একটি বহুজাতিক কোম্পানিও গতকালের আগে টানা পাঁচ দিন মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় লেনদেন হয়েছে।

গতকাল ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষস্থানটি দখলে রাখে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। চার হাজার ৫০০টি হাওলায় এদিন কোম্পানিটির ২০ লাখ ৯৬ হাজার শেয়ার হাতবদল হয় যার বাজারমূল্য ছিল ২১ কোটি দুই লাখ টাকা। তিন হাজার ৫৬৮টি হাওলায় ১৬ লাখ ৮৭ হাজার শেয়ার ১৬ কোটি ৭১ লাখ বেচাকেনা করে বেক্সিমকো ফার্মা ছিল দিনের দ্বিতীয় অবস্থানে। ডিএসইর লেনদেনের শীর্ষ দশটি কোম্পানির মধ্যে আরো ছিল যথাক্রমে শাইনপুকুর সিরামিকস, বিচ হ্যাচারি, এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, উত্তরা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল টিউবস, রিলায়ান্স ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ড ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে ছিল উত্তরা ব্যাংক, বিচ হ্যাচারি, রিলায়্যান্স ওয়ান মিউচুয়্যাল ফান্ড, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, এনভয় টেক্সটাইলস, ক্রাউন সিমেন্ট, বেক্সিমকো ফার্মা, লাভেলো আইসক্রিম, রবি অজিয়াটা ও ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিং লিমিটেড।

ডিএসইতে দিনের মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ কোম্পানি ছিল রংপুর ফাউন্ড্রি। প্রাণ আরএফএল গ্রুপের এ প্রতিষ্ঠানটির মূলধন মাত্র ১০ কোটি টাকা। গতকাল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে দিনের শীর্ষে উঠে আসে কোম্পানিটি। ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে দিনের দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি ছিল মিডল্যান্ড ব্যাংক। মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ কোম্পাপনির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে রিলায়ান্স ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ড, ইস্টার্ন লব্রিকেন্ট, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ক্যাবলস, এএমসিএল প্রাণ, ন্যাশনাল টিউবস ও দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।

দিনের দরপতনের শীর্ষ কোম্পানি ছিল খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ। এ দিন ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ দর পতনের শিকার হয় কোম্পানিটি। দরপতনের দিক থেকে দিনের দ্বিতীয় কোম্পানি ছিল সোনারগাঁও টেক্সটাইলস। ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ দর হারায় বস্ত্র খাতের এ প্রতিষ্ঠান। একই খাতের এসকে ট্রিমস ও এস্কয়্যার টেক্সটাইলের দরপতনের হার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৬৯ ও ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ তালিকায় আরো ছিল এসএস স্টিলস, মিথুন নিটিং, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, এমকে ফার্মা, সাফকো স্পিনিং ও ডমিনেজ স্টিলস লিমিটেড।

ঢাকা শেয়ারবাজারে গতকাল এক লাখ ৫১ হাজার ৮১৬টি হাওলায় মোট ১৫ কোটি ৯২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৬টি শেয়ার ও মিউচুয়্যাল ফান্ড হাতবদল হয় যার বাজারমূল্য ছিল ৪৪৬ কোটি টাকা। লেনদেন হওয়া ৩৯৭টি কোম্পানিও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৯৮টির দাম বাড়ে, ২৫৫টির দাম হ্রাস পায় এবং ৪৪টির দাম অপরিবর্তিত ছিল।