জাপা ও বামপন্থীদের ওপর ভর আ’লীগের

মনিরুল ইসলাম রোহান
Printed Edition

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর নানা রূপ নিয়ে নানা বেশে বিভিন্ন আন্দোলনের ওপর ভর করে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে চেয়েছিল দলটি। বারবার সেসব কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর এবার তাদেরই দোসর জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বামপন্থীদের ওপর ভর করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগ ছক কষছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

দীর্ঘদিন যাবৎ আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে মন্ত্রী-এমপির পদ বাগানোসহ নানান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছে জাতীয় পার্টি। গত ৫ আগস্টে পটপরিবর্তনের পর অনেকটা চুপ হয়ে যায় তারা। হাতেগোনা দুই-একটা বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও স্বৈরাচারের দোসরের তকমা পাওয়া ওই দলটি রাজনীতিতে হঠাৎ সরব হয়ে উঠেছে। গত শনিবার বরিশালে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ হামলা করে রক্তপাত ঘটানোর পরই তারা নতুন করে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। যদিও ওই এলাকায় দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত নয়। তারপরও হঠাৎ করে গণঅধিকার পরিষদের ওপর হামলা ও এর পেছনের শক্তির জোগানদাতাদের নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

স্থানীয় সূত্র বলছে, গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের সামনের সারিতে হাতেগোনা কয়েকজন জাতীয় পার্টির নেতা থাকলেও পেছনের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য স্বৈরাচারের দোসরদের ভেতরে ঢুকে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ গণ অধিকার পরিষদের নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা চালিয়েছে এমন অভিযোগও করেছেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

গণ অধিকার পরিষদ বাকেরগঞ্জ উপজেলার সহ-সভাপতি মাসুদ রানা সাংবাদিকদের বলেছেন, আওয়ামী লীগের দোসররা ঠিক আওয়ামী লীগ হয়েই ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি পাতানো নির্বাচনে প্রতারণামূলক অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করায় জাপাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। জি এম কাদেরসহ দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং তাদের নিবন্ধন বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি। এর আগে ছক অনুযায়ী জুডিশিয়াল ক্যু করার পথে আওয়ামী লীগ এগোলেও পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের দ্রুত পদক্ষেপে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এরকম আনসার বিদ্রোহ, পোশাক খাতে অস্থিরতা, পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ভূমিকা রাখাসহ আরো কিছু কর্মকৌশল নিলেও ওই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তা ভেস্তে যায়। এখন অন্তর্বর্তী সরকার যখন জুলাই গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে তখনই দেশে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সচিবালয় সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই একেক সময় একেকটি গ্রুপ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত হাজির হচ্ছেন। এগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী আমলারা। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও আওয়ামী আমলের আমলারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের কাছ থেকেও পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। যা নিয়ে তুমুল সমালোচনা থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সব কর্তাব্যক্তিই অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে মিশে গিয়ে এখন শেখ হাসিনার বিচার বন্ধ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার জন্য উসকে দিচ্ছে। আর তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী এবং তার সহযোগী সংগঠনের কম পরিচিত ও অপরিচিত মুখগুলো।

এ দিকে কৌশলে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য বামপন্থী দলগুলোও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এতদিন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে স্লোগান দিলেও সম্প্রতি উল্টো সুরে কথা বলা শুরু করেছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বামপন্থী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর এখন আওয়ামী লীগ ভর করেছে। জুলাই গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনার সমর্থকগোষ্ঠী বামপন্থীদেরও বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বিচারের নাম করে অন্তর্বর্তী সরকার সময়ক্ষেপণ করছে। এজন্য নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতেও গড়িমশি করছে। এটি বামপন্থীদের পক্ষেই যায়। যদিও দেশকে অস্থিতিশীল করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ছড়ানোর বিষয়টি সম্প্রতি তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এবং তার দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করতেছে। তারা অনেক টাকা দেশ থেকে স্থানান্তর করেছে। ওই টাকা এখন তারা ব্যবহার করতেছে। ওই টাকা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে ব্যবহার করে দেশকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করতেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে জানান, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের পতন ঘটলেও বিদেশে বসেই ভারতের সহায়তায় শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য একেক সময় একেক আন্দোলনের ওপর ভর করেন। এই যে একের পর এক বিভিন্ন লোকজন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে, আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রেতাত্মারা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। তিনি বলেন, গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। তাদে বিচার হতে হবে।