তরুণরা জুলাই-আগস্টের রাজপথে রক্ত দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তার সুবিধাভোগী এখন দেশের কে নন। নবীনরা দল করে এখন তাদের অনেকের চক্ষুশূল। তবে এটা মিথ্যা নয় দল না করলে তাদের আদর সোহাগের কোনো কমতি হতো না। এখন নতুন দলকে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেকে ভাবছে। গোল তো বেঁধেছে এখানেই। তবে, ধৈর্য, প্রত্যয় প্রচেষ্টা কামিয়াবির পূর্বশর্ত। যারা অধৈর্যের চাষাবাদ করছে, এর প্রতিফল কেবল মাকাল ফল
আজকের এ লেখা শুরু করব বরিশাল শহরের ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী এক মহিলা কবি, কুসুম কুমারী দাশের একটি কবিতার উদ্ধৃতি করে। (জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৫ সাল-মৃত্যু ১৯৪৮) বিখ্যাত সে কবিতাটি অতীতে একসময় বহুল পঠিত ছিল। বহুল পঠিত সেই কবিতাটির শিরোনাম ‘আদর্শ ছেলে’। তার প্রথম ছয়টি ছত্র হচ্ছে, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?/ মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন/মানুষ হইতে হবে, ‘এই তার পণ/ বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান/ নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?’। ’৭১ সালে স্বাধীনতা উত্তরকালে কবিতাটি শিশুদের মানস গঠনে পাঠ্য তালিকায় ছিল। এখন যেন এমন সব বাণী, চিরন্তনী কালোত্তীর্ণ কাব্য-কবিতার আর প্রয়োজন আছে বলে হয়তো মনে করা হচ্ছে না। আমরা যেন এমন সব কবিতার সার-নির্যাস হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছি, এখন কেউ যেন আর কথায় ‘দড়’ নয়। সেই অনুভব থেকে আমাদের ‘বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ’ পাঠ্যসূচি প্রণেতারা পাঠক্রম থেকে এসব ‘ছাইপাশ’ বাদ দিয়েছেন। সেই সাথে অসার অলীক অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তারা হয়তো এমনো মনে করতে পারেন, এখন তো কাজের যুগ নয়, নিছক কথামালার যুগ। যাই হোক, পাঠ্যক্রম নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এ লেখা নয়। আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সেই ভিন্নতা উপলব্ধি করে এ রচনা। আমরা এখন সে আলোচনায় যাবো।
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তার লক্ষ্য ছিল মোটা দাগে একটি। তবে এই একের মাঝে লুকিয়ে আছে আরো অনেক উপকথা। সে কথা আছে স্বৈরাচারের ইতি ঘটানো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমুন্নত করা, সঠিক বন্ধুদের খোঁজা, কোনো বন্ধুর পকেটে না ঢোকা, দেশের নাগরিকদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বিশ্বাস সংরক্ষণ, নৃ-তাত্ত্বিক ভেদাভেদ মুছে ফেলা। সব বৈষম্যের অবসান, নারী-পুরুষের যৌক্তিক অবস্থান নিশ্চিত করা, দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ দৃঢ় করা, সঠিক শিক্ষার প্রবর্তন, বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা। এসব দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়েছিল অবাক করার মতো গণজোয়ার। যেন মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসা ঝর্ণার ফল্গুধারা। তাতে স্বৈর যুগের অবসান হলেও স্বৈরাচারের অন্যান্য উপসর্গ ও নানান শৈলী এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সেটা প্রবীণদের গায়ে আঁচড় না কাটলেও নবীনদের হৃদয়ে তার আঁচড় লাগছে। নবীনদের এখন কাজ হওয়া উচিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা’ কবিতাটির সারমর্মটি উপলব্ধি করা। কবিতাটির প্রথম আট চরণ হচ্ছে- ‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা/রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/ আজকে যে যা বলে বলুক তোরে/ সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে/ পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা/ আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা’।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সেই তরুণের এসব গান কবিতা তাদের সম্মুখপানে চলার দিক-নির্দেশনা দেবে।
ইতোমধ্যে তরুণরা বলেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের হাল ধরতে তারা নতুন রাজনৈতিক দল করবে। এটা সবার জানা, মেয়াদোত্তীর্ণ দাওয়াই হোক বা রাজনীতি হোক, তাতে দেহের বা রাষ্ট্রের রোগ সারতে পারে না। সব কিছুতে হালনাগাদ থাকতে হয়। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, নতুনদের আসন সবসময় তাদের নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে। সে জন্য যুদ্ধ করে আসন নিতে হয়। অতীত বলে, কেউ কখনো কারো আসন এমনিতে ছাড়ে না। তবে সেটা মল্লযুদ্ধ নয়, মেধা বুৎপত্তি কৌশলে আর সময়ের সাথে যুদ্ধ। নিজের চেয়ার নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। তবে অভিজ্ঞতা এটা স্মরণ করিয়ে দেয়, কখনো ধরাকে সরাজ্ঞান করা নয়। সেটা হবে অচিন্ত্যপূর্ব হঠকারিতা। সবাই বা সব দল নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে প্রতিশ্রুতির মহাকাব্য রচনা করে জনকল্যাণে হাজারো কর্ম-সম্পাদনের আশ্বাস দেয়। সে কাব্যে এমন কথাও থাকে, জনগণের প্রয়োজনে তারা আকাশ থেকে চাঁদ পর্যন্ত নামিয়ে আনবে। কিন্তু দিনান্তে দেখা যায়, দলের নেতাকর্মীদের প্রায় প্রত্যেকে সেই মহাকাব্যের দশটি লাইন পর্যন্ত স্মরণ করতে পারেন না। সেজন্য মনে রাখতে হবে জনগণকে আর দিন-রাত প্রতিশ্রুতির পালাগান শোনবেন না। ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে এক কথা বারবার শোনাবেন না। গল্পে আছে শিয়াল এক কুমির ছানাকে বারবার দেখিয়ে মা কুমিরকে সন্তুষ্ট করত। আর অনেক দলের শত শত প্রতিশ্রুতি বৃত্তাকারে চরকির মতো ঘোরে। এসবের অর্থ হচ্ছে, জনগণকে দেয়া ওয়াদার চরম হেলাফেলা। পতিত স্বৈরাচার এমন কথাও শুনিয়েছে, বাংলাদেশ নাকি চন্দ্রাভিযানেও যাবে। ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার। অথচ বিগত ৫২ বছরে কোনো সরকার জনগণের মাত্র পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। অথচ ৫২ বছরের মানুষের হাজারো চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে আকাশ ঢেকে দিয়েছিল। তবে নিজেদের পকেট কিন্তু খালি রাখেনি। তরুণরা রাজপথ-গলিপথে যেসব দেয়াললিপি লিখে যে বার্তা মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন, সেখানে এখন দাড়ি চিহ্ন লাগিয়ে দিন। ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন সাপেক্ষে না হয় নতুন ফর্দ তৈরি করে নেবেন। বেশি কথা বললে সেখানে সত্য-অসত্যের মিশ্রণ অবশ্যই ঘটবে। রাজনীতির নতুন ও পুরনোদের পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। শুধু তাই নয়, সেটা বড্ড পিচ্ছিল পথ। যেমন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, তার ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায়, দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!/ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/ ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?/ কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/ এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার/তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!/ যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান/ ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান/ ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার’। এটা শুধু কাব্য নয়; মুক্তির এক ঐতিহাসিক মূল মন্ত্র। ভুল করেও ভাববেন না এসব আমাদের জন্য পরামর্শ, নিছক পর্যবেক্ষণ। পরামর্শ দেয়ার মতো জ্ঞান গরিমা আমাদের কোথায়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যার কোনো শেষ নেই। মিনি-ছোট-মাঝারি- বড় দল। আকাশের তারা যেমন গুনে শেষ করা যায় না, তেমনি এ দেশে দলের সংখ্যাও বেসুমার। এ অবস্থায় তরুণদের আরো একটি দলের প্রয়োজনটা কেন? এ প্রশ্নের উত্তর নতুন দলের নেতাকর্মীদের জোরালোভাবে দিতে হবে। তাদের কাজকর্মে, কর্মসূচির ও বাক্য বচনে। রাজনৈতিক অঙ্গনের নানা আচরণ এবং অনুশীলন ও যেসব শৈলী আছে। যদি দল গঠনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে না পারেন, তবে সেটা হবে নিছক দল করার জন্য দল করা বা নেতা হওয়ার জন্য দল করা। অন্যদের সাথে আপনাদের ইতিবাচক পার্থক্য হবে রাজনৈতিক দল গঠনের সার্থকতা।
প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হবে এটা স্বাভাবিক। নতুন দল গঠনের বার্তা পাওয়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রিয়ার সাথে দারুণ প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে। এটা হচ্ছে নতুন দলের জন্য একটা দারুণ ইতিবাচক ক্রিয়া। রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও বিভিন্ন অঙ্গনে এ দল নিয়ে আলোচনা মূল্যায়ন ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হচ্ছে। এসব নিয়ে নতুন দলের তরুণদের শুধু আহ্লাদিত হলে চলবে না। এসব কথার ভেতর যে বার্তা ও বিশ্লেষণ আছে, সেগুলোও পর্যালোচনা ও ভালো-মন্দের যেসব ভেদাভেদগুলো আছে সেগুলো মন-মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে। এমন সব আলোচনা প্রমাণ করে নতুন রাজনীতির আকাক্সক্ষা থেকে বাংলাদেশের মানুষ এখনো সরে আসেনি। নতুন দল ঘোষণার প্রাক্কালে নতুন দলের উদ্দেশ্য হিসাবে যা বলা হয়েছে ছাত্র-জনতার বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া গেছে, তার উদ্দেশ্য কেবল একটি সরকারের পতন ঘটিয়ে আর একটি সরকার বসানো নয়। কথাগুলো অবশ্যই নতুন এবং মনোমুগ্ধকর। তবে মনে রাখতে হবে, সব ভালো, ভালো নয়, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।
নতুন দল (এনসিপি) এখন অনেকের চোখের বালি হয়ে থাকবে। পান থেকে চুন খসলে অনেকে জাপ্টে ধরবে। সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে, দশ মণ দুধে এক ফোঁটা ‘গো চোনা’ সব দুধ নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাই অনেক ভালো কাজ করলেও, একটি মন্দ কাজ সব বরবাদ করে দিতে যথেষ্ট। সময়টা এখন বড্ড খারাপ, চতুরদিক থেকে নাগিনরা ছাড়ছে নিঃশ্বাস। সুকান্তের ভাষায়, ‘অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। আসলেই বাংলাদেশ এখন একটা ক্ষুব্ধ জনপদ হিসেবে চিহ্নিত, পতিতরা দেশের অধগতির জন্য অনবরত অপকৌশল করছে। এমন সঙ্কট কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠী সরকারের একার নয়, সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সুখের ভাগ নিতে সবাই প্রস্তুত, কিন্তু দুঃখের ভাগ কখনো কেউ ভাগাভাগি করে না। নতুন দলকে সঙ্গত কারণে এ নিয়ে কথা বলতে হবে। কাজ করতে হবে। এ দলের মাঝে যারা ছিল বা আছেন, তাদের এখন নতুন দিনের কাণ্ডারী হতে হবে। সব ভয় জয় করতে হবে। যাই হোক, ভুলে গেলে চলবে না- সত্য, এটা কেউ কারো জন্য কোনো সুযোগ তৈরি করে দিলে সেটা প্রচার করতে নেই। কারো জন্য কিছু করলে প্রতিদান-প্রত্যাশার প্রয়োজন নেই। তরুণরা জুলাই-আগস্টের রাজপথে রক্ত দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তার সুবিধাভোগী এখন দেশের কে নন। নবীনরা দল করে এখন তাদের অনেকের চক্ষুশূল। তবে এটা মিথ্যা নয় দল না করলে তাদের আদর সোহাগের কোনো কমতি হতো না। এখন নতুন দলকে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেকে ভাবছে। গোল তো বেঁধেছে এখানেই। তবে, ধৈর্য, প্রত্যয় প্রচেষ্টা কামিয়াবির পূর্বশর্ত। যারা অধৈর্যের চাষাবাদ করছে, এর প্রতিফল কেবল মাকাল ফল।
এ লেখা শেষ করার আগে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের আরেকটি কবিতা উদ্ধৃতি করছি নতুনদের উদ্দেশে, ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণী তল/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত/ আমরা টুটাব তিমির রাত/বাধার বিন্ধ্যাচল’। নতুন এক প্রতুষ্যের প্রত্যাশায় নতুন দলকে এমন সব বাধা-বিপত্তি দূর করে অগ্রসর হতে হবে। এ দেশের মানুষ অল্পতে তুষ্ট। তারা সবাই কেবল এমন একটা দেশ চায়- ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;/ ও সে, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে-যে, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা; / এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ ও সে সকল দেশের রাণী সে যে- আমার জন্মভূমি। নতুনদের এটাই হওয়া উচিত।