নিয়োগ পদোন্নতিতে জালিয়াতি, শিক্ষা প্রকৌশলে অস্থিরতা

শিক্ষা খাতের অনেকেই অভিযোগ করেন আওয়ামী আমলে ৩৮তম বিসিএস ২০১৮-এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু ক্যাডার পদে সুপারিশ প্রাপ্ত নন এমন তালিকা থেকে নন-ক্যাডার পদে ৮৫ জনের মধ্যে ২৮ জন সাধারণ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে নন ক্যাডার হিসেবে ৮৫ প্রকৌশলী নিয়োগে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট দোসরদের ২০২৪-এর ৫ আগস্টের আগের দিনগুলোতে গোপন ষড়যন্ত্র এবং নানা কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগও নতুন করে সামনে এসেছে। আওয়ামী আমলের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির মধ্যে আঁৎকে ওঠার মতো ঘটনা ছিল প্রকৌশলী চাকরির পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই শিক্ষাপ্রকৌশল খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রকৌশলী পদ জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করেছেন ২৮ কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের প্রকাশিত পরীক্ষার ফলাফল যাচাই করে দেখা গেছে চাহিদা মতো যোগ্যতা না থাকার পরও ২৮ কর্মকর্তাকে প্রকৌশল খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল শুধু শেখ হাসিনার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হিসেবে। নিয়োগ পাওয়া ওই কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই তখন অভিযোগ ছিল ছাত্রলীগের নানা কমিটির সাথে যুক্ত থাকার। আবার এদের অনেকেই ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান রুখতে অস্ত্র হাতে মাঠে নামার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

শিক্ষা খাতের অনেকেই অভিযোগ করেন আওয়ামী আমলে ৩৮তম বিসিএস ২০১৮-এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু ক্যাডার পদে সুপারিশ প্রাপ্ত নন এমন তালিকা থেকে নন-ক্যাডার পদে ৮৫ জনের মধ্যে ২৮ জন সাধারণ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অর্থাৎ শিক্ষা প্রকৌশল খাতে কর্মরত ২৮ জন নির্ধারিত পরীক্ষায় প্রকৌশল খাতে পরীক্ষা না দিয়েও এখন প্রকৌশলীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন। অনিয়ম আর জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এমন কয়েকজনের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল এবং তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙের চূড়ান্ত তালিকা এসেছে নয়া দিগন্তের হাতে। পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেডে পাস করা এই ব্যক্তিদের প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, অথচ ছাত্রলীগ পদ-পদবিধারী/দোসরদের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হওয়ায় সেই সময় সরকারি নিয়োগ বিধিমালা সবকিছু উপেক্ষা করে এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাছের লোকজন হিসেবে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এসব প্রকৌশলী এখন শিক্ষা প্রকৌশলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে বর্তমান সরকারকে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করার সুপরিকল্পিত নীলনকশা নিয়েও গোপনে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের অনেকে।

সূত্র মতে শিক্ষা প্রকৌশল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিভাগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় পদের নাম সহকারী প্রকৌশলী (পুর) (নবম গ্রেড) নিয়োগ পাওয়া ২৮ কর্মকর্তা হচ্ছেন নিয়োগ পরীক্ষার রেজি.: নম্বর ০২৩২৫৫, ০৫০৫৮১, ০৮৬৪৮২, ৩০১৫৬৩, ০৬১২০৫, ৮০০১৬০, ০৭১১৭০, ১২৫৮৭৮, ০২১৩১৫, ০১০০৫৫। এমন ২৮ জন প্রার্থী যারা নন টেকনিক্যাল প্রার্থী হয়েও অনিয়ম আর আওয়ামী পরিচয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রকৌশলী হিসেবে নন ক্যাডার হিসেবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। এরা একেকজন প্রকৌশলের ছাত্র হলেও প্রকৌশলের খাতে নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। বরং সাধারণ ক্যাটাগরিতে পাস করে বিশেষ ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ম্যাসেজ এবং আশীর্বাদেই প্রকৌশলী হয়ে বসে আছেন। অথচ কোনোবিচারেই তাদের প্রকৌশলী হওয়ার বা পদ গ্রহণের সুযোগ নেই। তারা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোই শুধু দখল করেনি, এখন নানাভাবে প্রকৃত প্রকৌশলীতে কাজে বাধার সৃষ্টি করছেন। অতীতের কৃতজ্ঞতা মাথায় রেখে এসব কর্মকর্তা শেখ হাসিনার লোকজনকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে চলছেন। একই সাথে জুলাই বিপ্লবের চেতনাধারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। শুধু গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার দখল নয়, জুলাইয়ের চেতনার সরকারকে বিপদে ফেলছে, বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের সাথে এসব কর্মকর্তা জড়িয়ে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অন্য দিকে কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডারে পাস না করে এবং বিতাড়িত স্বৈরাচার সরকারের ৩৮ বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে নিয়োগকৃত সহকারী প্রকৌশলী পদে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা শিক্ষা অধিফতরের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টিতে যাদের নাম আসছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের অন্যতম সদস্য নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল করিম, খন্দকার নাজমুল হাসান, গোলাম মুত্তাকিন, ইসতিয়াক ইকবাল হিমেল, শহিদুল ইসলাম। তারা বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। জুলাই অভ্যুত্থান রুখে দিতে এরা সবাই রাজপথে শুধু সক্রিয়ই ছিলেন না সরাসরি ছাত্রদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে ফান্ডিং করা ছিল এসব প্রকৌশলীর অন্যতম দায়িত্ব। অথচ এরা সবাই এখনো শিক্ষা প্রকৌশলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তাদের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন।

সূত্র আরো জানায় বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের এক সদস্য সম্পা সাহা ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পরপরই আমেরিকায় পালিয়ে গেছেন। ফ্যাসিবাদের কিছু দোসর, যারা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ গঠনের জন্য ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের সাথে সর্বক্ষণ সমন্বয় সাধন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ইইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী শাহ নঈমুল কাদের, চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ছিলেন অন্যতম। গত এক বছরের বেশি সময়ে শিক্ষা প্রকৌশলে অন্য প্রকৌশলীদের মধ্যে এ নিয়ে চরম ক্ষোভ আর অস্বস্তি থাকলেও দোসরদের দাপটে কোনোভাবেই লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা প্রকৌশল সূত্র বলছে, ইমরান হোসেইন খান, প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার, নাজমুস সাকিব তারেকসহ অনেকেই বিগত সরকারের আমলে ঢাকা মেট্রোতে গুরুত্বপূর্ণ পদায়নে থেকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অফিস টাইমে অফিসের কাজ না করে বিগত সরকারের দোসর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মো: সবুর হোসেনের দোসর হিসেবে কাজ করতেন। ২০২৪-এর পাতানো নির্বাচনে সরকারি অফিস বাদ দিয়ে তারা কুমিল্লা সবুরের এলাকায় গিয়ে ও অবৈধভাবে রাতের ভোটের সহচর ছিলেন। অথচ অজানা রহস্যে এখন পর্যন্ত তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে গতকাল রোববার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু অভিযোগ আমরা শুনেছি। তবে লিখিত কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে কেউ দেয়নি। যেহেতু বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি কাজেই এ নিয়ে তদন্ত করা হবে। নিয়োগে কোনো গুরুতর অনিয়ম আর জালিয়াতির বিষয়টিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। তবে গতকাল সন্ধ্যায় ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো: আলতাফ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।