‘জান দেব, জুলাই দেব না’- এই এক বাক্যের প্রতিজ্ঞায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে বাঁচিয়ে রাখতে, আধিপত্যবাদবিরোধী আকাক্সক্ষাকে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে যিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। সংস্কার, বিচার, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াই কোনো প্রশ্নেই আপস করেননি এই তরুণ বিপ্লবী। সেই আপসহীনতার মূল্য চুকাতে হলো জীবন দিয়ে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর টানা ছয় দিন জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়াই শেষে অবশেষে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান শরিফ ওসমান হাদি। মৃত্যুর আগেও তিনি ভীত ছিলেন না সহযোদ্ধাদের ভাষায়, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও হাসতে হাসতেই মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন তিনি। মহান আল্লাহ তায়ালা তার সেই দোয়াকে কবুল করেই কাছে টেনে নিয়ে গেলেন।
যেভাবে বেড়ে উঠা বিপ্লবী শরিফ ওসমান বিন হাদির
১৯৯৩ সনে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় হাদির জন্ম। বাবা পেশায় একজন মাদরাসা শিক্ষক ছিলেন । সেখান থেকেই তার শিক্ষাজীবনের শুরু, ঝালকাঠির নেছারাবাদ কামিল মাদরাসায় পড়াশোনা শেষে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। শিক্ষাজীবন থেকেই রাজনীতি, সংস্কৃতি ও চিন্তাশীল লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন হাদি। অভ্যুত্থানের আগে লেখক হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। ‘লাভায় লালশাক পূবের আকাশ’ শিরোনামে একটি কবিতার বই লেখেন তিনি। লেখালেখিতে ব্যবহার করতেন ‘সীমান্ত শরীফ’ নামটি।
ইনকিলাব মঞ্চের দর্শন ও লক্ষ্য; যেভাবে লাইমলাইটে আসা হাদির
জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই হাদি জাতীয় পরিসরে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য ছিল, সব ধরনের আধিপত্যবাদ মোকাবেলা করে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ। অভ্যুত্থানের পর তরুণদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটিতেও যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে নিজেকে কেবল রাজনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ না রেখে ইনকিলাব মঞ্চেই সক্রিয় থাকেন। জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তও ছিল তার আদর্শিক অবস্থানের প্রতিফলন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ, অভ্যুত্থানে জড়িতদের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবিতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠগুলোর একটি। ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধেও একাধিক কর্মসূচি পালন করেন তিনি। রাজপথ, টিভি টকশো কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সবখানেই জুলাই অভ্যুত্থানের প্রশ্নকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিলেন হাদি। একই সাথে তিনি জুলাইয়ে নিহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও আহতদের যথাযথ চিকিৎসার দাবিতে ধারাবাহিকভাবে কথা বলেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্র ও পরে জুলাই সনদ নিয়েও তার স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান তাকে বারবার আলোচনায় নিয়ে আসে। এর আগে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতা, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও শাপলা চত্বরের ঘটনার বিচার দাবি, ২০২১ সালের মোদিবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড এবং সীমান্ত হত্যা, সব ইস্যুতেই তার অবস্থান ছিল দৃঢ় ও স্পষ্ট। এই আপসহীন অবস্থানের কারণে শত্রুও তৈরি হয় তার। গত সেপ্টেম্বর থেকেই হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেই জানিয়েছিলেন, দেশী-বিদেশী অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে, এমনকি তার পরিবারকে ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। তবে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি- এ নিয়ে মৃত্যুর পর সরকারের সমালোচনাও জোরালো হয়েছে।
ঢাকা-৮ আসনে এমপি পদে নির্বাচন
২০২৫ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন ওসমান হাদি। মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত এই আসনে তিনি প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি মতবিনিময়, ‘চা-শিঙ্গাড়া’ আড্ডা এবং পথসভা আয়োজনের ঘোষণা দেন। তার এই ভিন্নধর্মী প্রচারণা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
হুমকি, হামলা ও মৃত্যু
গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর নির্বাচনী প্রচারণার সময় গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই আর জ্ঞান ফেরেনি তার। শেষ পর্যন্ত চোখ না খুলেই থেমে যায় এক বিপ্লবী জীবনের অধ্যায়। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে অনেক আগে থেকেই একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিলেন ওসমান হাদি। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সেটি বলেছেন।
রাজনৈতিক উত্তরাধিকার
স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক জীবনে ওসমান হাদি তরুণদের মধ্যে প্রতিবাদী রাজনীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার মৃত্যু শুধু ঢাকা-৮ নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতেও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তরুণ নেতৃত্ব, আন্দোলনভিত্তিক রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে। শরিফ ওসমান হাদি নেই, কিন্তু জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা এখন হাজারো তরুণের কণ্ঠে, রাজপথে এবং প্রতিরোধে।



