ভারতের লোকসভায় পাস হওয়া বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছেন বিরোধীদলীয় দুই সংসদ সদস্য (এমপি)। আবেদনে প্রস্তাবিত আইনটিকে ‘মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিলটি পাস হওয়ার পরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি মুসলিম সংগঠন থেকে মামলা করার ইঙ্গিত দেয়া হয়। সেই সাথে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড জানিয়েছে, এই আইনের বিরুদ্ধে তারা দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলবে। খবর : এনডিটিভি ও হিন্দুস্তান টাইমস।
কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জাভেদ ও এআইএমআইএমের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিতর্কিত বিলটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে পৃথক আবেদন দাখিল করেছেন। এই বিলে আনা বিধানগুলোকে ‘মুসলমানদের মৌলিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে আবেদনে উল্লেখ করেছেন তারা।
এ দিকে ওয়াক্ফ বিল সমর্থন করায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দল জেডিইউতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই দিনে ৫ নেতা দল ত্যাগ করেছেন। ওই ৫ নেতার মধ্যে ৪ জন মুসলিম হলেও একজন হিন্দু। রাজু নায়ার নামে ওই হিন্দু নেতা তার পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, ‘দলের ভূমিকায় আমি হতাশ। এটি আরেক কালা আইন। মুসলিমদের ওপর অত্যাচার ও অবিচার এতে আরো বাড়বে।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজ্যসভায় দীর্ঘ আলোচনার পর ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি পাস হয়। বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার জন্য দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছে। সংসদ সদস্য জাভেদ তার আবেদনে বলেছেন, বিলটি মুসলমানদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। তিনি উল্লেখ করেন, বিলটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ (সমতার অধিকার), ২৫ (ধর্ম পালনের স্বাধীনতা), ২৬ (ধর্মীয় বিষয় পরিচালনার স্বাধীনতা), ২৯ (সংখ্যালঘু অধিকার) এবং ৩০০এ (সম্পত্তির অধিকার) লঙ্ঘন করে।
জাভেদ লোকসভায় কংগ্রেসের হুইপ। তিনি ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল সম্পর্কিত যৌথ সংসদীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন। কংগ্রেসদের এই সংসদ সদস্য তার আইনজীবী আনাস তানভীরের মাধ্যমে দায়ের করা আবেদনে বলেছেন, প্রস্তাবিত আইনটিতে আরোপিত বিধিনিষেধগুলো অন্যান্য ধর্মের দান পরিচালনার ক্ষেত্রে নেই। যা অন্যান্য ধর্মীয় দান পরিচালনায় উপস্থিত নেই। এটি মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক।
উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু ও শিখ ধর্মীয় ট্রাস্টগুলো কিছুটা নিজেদের বিধি মোতাবেক চলেছে। ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের সংশোধনী ওয়াকফ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়িয়েছে। আবেদনে আরো বলা হয়, এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ ১৪ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘনের শামিল। একই সাথে এমন স্বেচ্ছাচারী শ্রেণী বিভাগ প্রবর্তন করা, যার অর্জন করতে চাওয়া লক্ষ্যগুলোর সাথে যুক্তিসঙ্গত নয়।
জাভেদ বলেন, প্রস্তাবিত আইনে একজন ব্যক্তির ধর্মীয় অনুশীলনের সময়কালের ওপর ভিত্তি করে ওয়াকফ তৈরিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়, এ ধরনের সীমাবদ্ধতা ইসলামী আইন, রীতিনীতিতে নজিরবিহীন এবং ২৫ অনুচ্ছেদের অধীনে ধর্ম পালন ও পালনের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন করে। এই নিষেধাজ্ঞায় যারা সম্প্রতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ধর্মীয় বা দানের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি দিতে চান, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে, যার ফলে অনুচ্ছেদ ১৫ এর লঙ্ঘন হয়।
আবেদনে আরো বলা হয়েছে, ওয়াকফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ওয়াকফ সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোতে অমুসলিম সদস্যদের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুুক্তির বিধান ধর্মীয় শাসনে একটি অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ।
ভারতজুড়ে বিক্ষোভ :
লোকসভায় বিতর্কিত মুসলিম ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল পাসের প্রতিবাদে কলকাতা, চেন্নাই ও আহমেদাবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে কলকাতা, চেন্নাই ও আহমেদাবাদসহ ভারতের বিভিন্ন শহরের সড়কগুলো। অসংখ্য মানুষ হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাদের হাতে নানা ধরনের প্ল্যাকার্ডও দেখা গেছে। তাতে লেখা ছিল, ‘আমরা ওয়াক্ফ সংশোধনী মানছি না’, ‘ওয়াক্ফ বিল প্রত্যাহার করুন’।
হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরপরই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এই বিক্ষোভে অংশ নেন। এ দিন কলকাতায় প্রতিবাদের বহর ছিল অনেক বড়। গুজরাটের আহমেদাবাদেও এদিন ওয়াক্ফ সংশোধনীর বিরোধিতায় পথে নামেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশকে চড়াও হতে দেখা গেছে। ওয়াক্ফ সংশোধনীর প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবীণরা রাস্তায় বসলে তাদের জোর করে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে গুজরাট পুলিশ।
চেন্নাইয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়াক্ফ বিলের প্রতিবাদে রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদের ডাক দেয় অভিনেতা বিজয়ের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল তামিলাঙ্গ ভেত্তরি কাঝাগাম (টিভিকে)। টিভিকে কর্মীরা শুধু চেন্নাই নয়, সেই সাথে তামিলনাড়ুর অন্যান্য বড় শহরেও বিপুল জমায়েত করেন। আন্দোলনের ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়ে কোয়েম্বাটোর এবং তিরুচিরাপল্লির মতো শহরেও। বিক্ষোভকারীরা সমবেতভাবে স্লোগান তোলেন, ‘ওয়াক্ফ বিল প্রত্যাহার করুন’, ‘মুসলমানদের অধিকার কেড়ে নেবেন না’। ওয়াক্ফ বিল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, বাংলার মুসলমানদের অধিকার ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না।