একের পর এক আগুনের ধোঁয়ায় নাশকতার গন্ধ

দেশকে অর্র্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা

ভয়াবহ আকার ধারণ করে আগুন শুরু হয় না; বরং ছোট থেকে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিমানবন্দরে নিজস্ব ব্যবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট গাফিলতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে সেই গাফিলতিটা কী কারণে সেটি খুঁজতে হবে। জবাবদিহি না থাকলে এর ভয়াবহতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

আমিনুল ইসলাম
Printed Edition

কঠোর নিরাপত্তায় বেষ্টিত এলাকায় একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নশকতার গন্ধ পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে এমন নাশকতা ঘটানো হতে পারে। তারা বলছেন, ভয়াবহ আকার ধারণ করে আগুন শুরু হয় না; বরং ছোট থেকে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিমানবন্দরে নিজস্ব ব্যবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট গাফিলতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে সেই গাফিলতিটা কী কারণে সেটি খুঁজতে হবে। জবাবদিহি না থাকলে এর ভয়াবহতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) আগুন লেগে পুড়ে গেছে একটি পোশাক কারখানা ভবন। এর দু’দিন পর শনিবার কেপিআই খ্যাত রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি পণ্য মজুদ রাখার কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। যে আগুনে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুনে অত্যন্ত মূল্যবান তৈরী পোশাকের কাঁচামাল, স্যাম্পল, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামালসহ কোটি কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এমন একটি স্পর্শকাতর জায়গায় দিনে-দুপুরে এমন ভয়াবহ আগুন লাগলো কিভাবে। আর যখন লাগলোই তখন অ্যাভিয়েশনের নিজস্ব দমকল ইউনিট ব্যবহার করে অল্পতেই নেভানো সম্ভব হলো না কেন?

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আলী আহম্মেদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, আগুন শুরুতেই ভয়াবহ আকার ধারণ করে না। ছোট থেকে সময় নিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো- শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি কেপিআইভুক্ত (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) এলাকা, যেখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকার কথা। সেখানে আগুন লাগলেও এত সময় নিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করল কেন? বিমানবন্দরের ভেতরেই ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ইউনিট রয়েছে। তারা বিমানের আগুন নেভাতেও সক্ষম। এত শক্তিশালী ইউনিট থাকা সত্ত্বেও আগুন নিয়ন্ত্রণে এতটা সময় নেয়া কর্তৃপক্ষের গাফিলতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়।

আলী আহম্মেদের মতে, কেন আগুন লাগলো, কিভাবে লাগলো এবং আগুন নেভাতে বিলম্ব হলো কেন- তা স্পষ্টভাবে জানতে হবে। এ ঘটনাগুলোর দ্রুত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ এসব আগুন দেশের ভাবমূর্তি ও অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করার ইঙ্গিত হতে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের আরেক সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আবু নাঈম মো: শহিদউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার আলামত থাকতে পারে। শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন নেভানোর সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক। সম্প্রতি যেভাবে একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, তাতে দেশের অর্থনীতি দুর্বল করার কোনো পাঁয়তারা চলছে কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। দুর্ঘটনার আড়ালে নাশকতা লুকিয়ে থাকতে পারে।

আবু নাঈম জানান, আগুন লাগার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ফায়ার অ্যালার্ম ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সমন্বয়- সবকিছুই ব্যবস্থাপনার অংশ। সেখানেই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। বিমানবন্দরের মতো জায়গায় প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি থাকা উচিত নয়।

দেশের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পরপর আগুন লাগার ঘটনায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত। কে বা কারা এসব ঘটনার পেছনে জড়িত, কিংবা এটি নিছক দুর্ঘটনা কি না তা জানতে না পারলে এমন অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সাবেক এ দুই ডিজি।

এ দিকে বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজের অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র তা দ্রুত তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে যে, এটি কতটা অনিরাপদ। গত কয়েক বছর ধরেই আমরা রফতানিকারকরা অভিযোগ করে আসছি, আমাদের পণ্য খোলা জায়গায় রাখা হয়, যা নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, এই ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত তদন্ত শুরু করা উচিত। কারণ গত কয়েক দিনে স্থানীয় ও রফতানিমুখী একাধিক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম ইপিজেডে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের পর কার্গো ভিলেজে এ ধরনের ঘটনা আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতি বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। কার্গো ভিলেজ ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ হলো তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা, যারা তুলনামূলকভাবে হালকা যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি এবং তৈরী পোশাক ও নমুনা পাঠানোর কাজে এটি ব্যবহার করে থাকেন।

আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও এই কার্গো ভিলেজের মাধ্যমে তাদের গ্রাহকদের দলিলপত্র ও পার্সেল আকাশপথে আদান-প্রদান করে। এ ছাড়া ওষুধশিল্পের উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানির জন্য এবং কৃষিপণ্য রফতানিকারকরা বিশেষ করে শাকসবজি ও অন্যান্য পচনশীল পণ্য রফতানির জন্য এই কার্গো ভিলেজ ব্যবহার করেন।

গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট প্রায় ছয় ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানিয়েছেন, ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করেছে। অগ্নিনির্বাপণে কাজ করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দু’টি ফায়ার ইউনিটসহ নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী। কাজ করেছেন বিজিবির দুই প্লাটুন সদস্যও। সেই সাথে বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনুমানিক এক হাজার আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে সিইপিজেডের অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিক্যাল কোম্পানির গুদামে ভয়াবহ আগুন লাগে। প্রায় সাড়ে ১৭ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। অ্যাডামস তোয়ালে ও ক্যাপ এবং জিহং মেডিক্যাল সার্জিক্যাল গাউন তৈরির কারখানা।