মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পে ২৪৮ কোটি টাকা নয়ছয়

জিলানী মিলটন
Printed Edition

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সেচ বিভাগের অধীনে নেয়া মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পে ২৪৮ কোটি টাকা নয়ছয়ের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকল্প পরিচালনা, ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে কৃষকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়- সবক্ষেত্রেই অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

দুদক সূত্র জানায়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এসব অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে নিষ্কাশন সুবিধাসহ সেচব্যবস্থা উন্নয়ন করতে ‘মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে বিএডিসি। বছরে ৫১ হাজার টন ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ২৪৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়।

সূত্র বলছে, কাগজে-কলমে প্রকল্পটির ৭০-৭৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কাজের অগ্রগতি খুবই কম বলে জানা গেছে। প্রকল্পের ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি, কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো, কৃষকদের কাছ থেকে ঘুষগ্রহণ, নিম্নমানের কাজ এবং কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগের তীর বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের দিকে।

অভিযোগ উঠেছে, কাগজে-কলমে প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সিংহভাগ কাজের কোনো অস্তিত্ব নেই। নিজস্ব ঠিকাদার সিন্ডিকেট এবং প্রকল্প পরিচালকের যোগসাজশে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে প্রকল্পের বড় অংশের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রকল্পের মূল কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৩০টি সৌরচালিত ডাগওয়েল নির্মাণ, যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ১২ লাখ টাকা, প্রতি কিলোমিটার ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮০ কিমি খাল পুনঃখনন, ২৫৫টি পাম্প হাউজ নির্মাণ, যার প্রতিটির ব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ৯৫টি ২ কিউসেক ফোর্সমোড পাম্প সেট স্থাপন, যার প্রতিটির ব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ৫ কিউসেক সোলার পাম্প ২৫টি, যার প্রতিটির নির্মাণব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ১৫টি বড় আকারের সেচ অবকাঠামো, যার প্রতিটিতে ব্যয় ৪০ লাখ টাকা, ১২০টি মাঝারি আকারের সেচ অবকাঠামো, যার প্রতিটির ব্যয় ২৫ লাখ টাকা, ৩০০টি ছোট আকারের সেচ অবকাঠামো, যার প্রতিটির ব্যয় সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং ২১৫টি বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ, যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, মাঠপর্যায়ে এসব কাজের অনেকটাই হয়নি বা নিম্নমানের হয়েছে। টেন্ডার সিন্ডিকেট, কাগুজে বিল-ভাউচার তৈরি এবং নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বরাদ্দের বড় অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলে স্থাপন করা দুই শতাধিক সেচ প্লান্টের প্রতিটির জন্য স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ঠিকাদার মনোনয়নের ক্ষেত্রে মোট প্রকল্প ব্যয়ের পাঁচ শতাংশ কমিশন গ্রহণের অভিযোগও উঠেছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া অভিযোগ আছে, কাজ না করেই ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ অর্থ নেন প্রকল্প পরিচালক এবং ৬০ শতাংশ নেন ঠিকাদার।

অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ডিপিপিতে নির্ধারিত নকশা ও মান অনুযায়ী ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। তাছাড়া ঠিকাদার কাজ শেষ করে বিল তুলতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (২%), সহকারী প্রকৌশলী (১%), সাইট অফিসার (২%) এবং হিসাব সহকারীকে (১%) কমিশন প্রদান বাধ্যতামূলক ছিল বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকার বিএডিসি কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সমন্বিত কুষ্টিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নীলকমল পাল।

অভিযানকালে দেখা যায়, চার বছরে কাগজপত্রে প্রকল্পটির অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৭৫ শতাংশ। ২৪৮ কোটি টাকার প্রকল্পে ইতোমধ্যে ১৯২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে তা প্রতিফলিত হয়নি। প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ নয়ছয় এবং কাজের অস্তিত্বহীনতার কারণে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অনুসন্ধানের সুপারিশ করে।

সূত্রে জানা গেছে, দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে প্রকাশ্যে তদন্তের জন্য একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। টিম ইতোমধ্যে নথিপত্র যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। এ ছাড়া এর আগে দুদকের এনফোর্সমেন্ট অভিযানেও অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ মেলে।

এ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে। তাদের আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৯ কর্মকর্তাকে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের অনুরোধ করেছে দুদক। তাদের মধ্যে ২৫ নভেম্বর আসতে বলা হয়েছে বিএডিসির কুষ্টিয়া রিজিয়নের সহকারী প্রকৌশলী এরশাদ আলী ও হাফিজ ফারুক, উপসহকারী প্রকৌশলী মমিনুল ইসলাম, আদনান আল বাচ্চু, আসিফ মাহমুদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে।

পরের ধাপে ২৬ নভেম্বর তলব করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী খালেদা ইয়াসমিন, উপসহকারী প্রকৌশলী দিদার-ই-খোদা, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল হালিম, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হুমায়ুন কবিরকে।

এর পরদিন ২৭ নভেম্বর আসতে বলা হয়েছে মেহেরপুর বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী শাহজালাল আবেদীন, মাযহারুল ইসলাম ও শাহরিয়ার আহমেদ, উপসহকারী প্রকৌশলী লিমন হোসেন, ইকরামুল হক, শ্যামল হোসেন ও আশরাফুল ইসলামকে।

তাদের প্রত্যেককে নির্ধারিত তারিখে হাজির হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য চিঠিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো: আক্তার হোসেন এ বিষয় বলেন, সেচ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান টিম কাজ শুরু করেছে। তারা নথিপত্র সংগ্রহ করছে। অভিযোগ-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও রেকর্ডপত্র যাচাই শেষে অনুসন্ধান টিম কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।