বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও সক্রিয় ওষুধ উপাদান বা এপিআই উৎপাদনে এখনো স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। বিদেশনির্ভরতা কমাতে সরকার এপিআই পার্ক নির্মাণসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে এ শিল্পের বিকাশে এখনো বেশ কিছু বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে ওষুধ রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে : ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ওষুধ। আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানি ১৩ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে ১৫৭টিরও বেশি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। ওষুধ উৎপাদনের ৮০-৯০ শতাংশ এপিআই এখনো বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের এপিআই আমদানি করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ওষুধ উৎপাদনকারীরা বলছেন, দেশে এপিআই উৎপাদনে প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি অন্যতম প্রধান বাধা। কারণ এপিআই উৎপাদন একটি অত্যন্ত জটিল ও প্রযুক্তি নির্ভর প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে এখনো উচ্চমানের গবেষণাগার, প্রশিক্ষিত রসায়নবিদ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশলে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল তৈরি হয়নি। ফলে চাইলেও জটিল ও উচ্চমানের এপিআই উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
এ ছাড়া অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও এপিআই খাতের অগ্রগতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশবান্ধব স্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধা এখনো বহু এপিআই কোম্পানির কাছে পর্যাপ্তভাবে পৌঁছায়নি। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জের এপিআই পার্কে এখনো পুরোপুরি উৎপাদন শুরু হয়নি, অনেক প্লট ফাঁকা, অনুমোদনের জটিলতাও রয়েছে।
ওষুধ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচামাল আমদানির ওপর অতিনির্ভরতা ও উচ্চ খরচও একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে দেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ এপিআই তৈরির উপাদান ভারত, চীন, জার্মানি ও ইতালিসহ কিছু নির্দিষ্ট দেশ থেকে আমদানি করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর এই নির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে এবং সঙ্কটকালে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করে।
তারা বলছেন, নীতিমালা ও প্রশাসনিক জটিলতা আরো একটি বড় প্রতিবন্ধক। এপিআই সংক্রান্ত পণ্য উৎপাদন ও পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন প্রক্রিয়া, শুল্কনীতি ইত্যাদিতে সুস্পষ্ট ও সহায়ক পরিবেশের অভাব রয়েছে। প্রতিবন্ধকতা সহজে দূর না হওয়ায় উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হন, এ কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগও সময় মতো কাজে লাগানো যায় না।
আবার গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতেও বিনিয়োগের ঘাটতি রয়েছে। উন্নত দেশগুলো এপিআই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণায় বিনিয়োগ এখনো নগণ্য। ফলে নতুন পণ্য উন্নয়ন করতে চাইলেও করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ড. মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে এপিআই শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও বিরাজমান প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হলে সমন্বিত পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ওষুধ শিল্পকে স্বনির্ভর করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা খুবই সহজ। এ শিল্পটি বিকাশে সরকার সহয়তা করছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। সরকারি সহায়তা আরো ব্যাপক হলে ওষুধ শিল্পে উজ্জ্বল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে।’
এপিআই উৎপাদনে যত বেশি গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) খাতে ব্যয় করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি এ খাতটি স্বনির্ভর হয়ে ওঠবে। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে আরঅ্যান্ডডিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে তিন বছরে ২৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং সামনের দিনগুলো আরো বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে বলে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। জানা গেছে, এ খাতে এক বিলিয়ন ডলার (১০০ কোটি ডলার) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি নির্ভরতা কমাতে না পারলে এ শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না।