লুটপাট আর দেশবিরোধী চুক্তির জাঁতাকলে একমাত্র পাথর খনি

মধ্যপাড়া খনি আজ কেবল একটি খনির গল্প নয়; এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট, প্রশাসনিক দখলদারিত্ব ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার এক করুণ দলিল। এখন প্রশ্ন একটাই- এই খনি কি সত্যিই উদ্ধার হবে, নাকি লুটের স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে?

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

  • ৫০০ কোটি টাকা লোপাট
  • পলাতক মূল হোতা
  • বহাল লুটেরা সিন্ডিকেট

দেশের একমাত্র পাথর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মধ্যপাড়া কঠিনশিলা খনি আজ চরম সঙ্কটে। একসময় উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও শিল্পায়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত এই খনি এখন দুর্নীতি, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব, অসম চুক্তি ও প্রশাসনিক দায়হীনতার ভারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংশ্লিষ্টদের মতে, মধ্যপাড়ার এই করুণ পরিণতি কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যর্থতা নয়; বরং গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের একটি পরিকল্পিত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদাহরণ।

সম্ভাবনার খনি থেকে সঙ্কটের পথে

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি) ১৯৭৪ সালে দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায় ভূগর্ভের কঠিনশিলা খনি আবিষ্কার করে। পরবর্তী সময়ে কানাডার এসএনসি লিমিটেড এবং জাপানের নিপ্পন কো. ই কর্তৃক পরিচালিত সম্ভাব্যতা, আর্থিক ও বাজার সমীক্ষায় প্রকল্পটি লাভজনক বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৯৪ সালে পেট্রোবাংলা ও উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নামনামের মধ্যে ১৫৮.৮৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তির মাধ্যমে খনি উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর ২০০৭ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খনিযুগে প্রবেশ করে।

খনির নকশা অনুযায়ী দৈনিক তিন শিফটে পাঁচ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন পাথর উত্তোলনের সক্ষমতা থাকলেও এমজিএমসিএলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়, সীমিত জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়েই এক শিফটে গড়ে প্রায় এক হাজার মেট্রিকটন পাথর উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা গেলে খনিটি পুরো সক্ষমতায় পরিচালনা করা যেত।

জিটিসি চুক্তি : লুটপাটের সূচনা

কিন্তু দক্ষ জনবল গঠন ও প্রযুক্তি উন্নয়নের বদলে ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় খনিটি তুলে দেয়া হয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের হাতে। ২০১৩ সালে নোয়াখালীর কৃষকলীগ নেতা কাজী সিরাজউদ্দীনের মালিকানাধীন জার্মানিয়া-ট্রাস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) সাথে একটি মাইন ম্যানেজমেন্ট চুক্তি সই হয়। চুক্তির মোট মূল্য ছিল প্রায় ১৭৬ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ছয় বছরে ৯২ লাখ মেট্রিকটন পাথর উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, খনি থেকে পাথর উত্তোলনে জিটিসির নিজস্ব কোনো বিনিয়োগ ছিল না; বরং সরকার থেকে ৬৮ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে তারা কাজ শুরু করে। চুক্তির মেয়াদে ১২টি স্টোপ উন্নয়ন করার কথা থাকলেও জিটিসি মাত্র ছয়টি স্টোপ উন্নয়ন করে এবং উৎপাদন করে মাত্র ৩৭.৫৬ লাখ মেট্রিকটন পাথর। তবুও তারা চুক্তি মূল্যের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ তুলে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে লিকুইডেটেড ড্যামেজ আদায়ের কথা থাকলেও বাস্তবে তা আদায় হয়নি।

খনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, জিটিসির সাথে সম্পদিত প্রথম চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হলেও জিটিসির উপদেষ্টা যশোর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং যুবলীগের নেতা এবং সাবেক রাশিয়ান ছাত্রলীগের সভাপতি ফররুখ খান বাবুর নীলনকশায় বারবার বাধাগ্রস্ত করা হয়। ৫ আগস্টের পর বর্তমানে পলাতক কাজী সিরাজের অনুপস্থিতিতে তিনি কোম্পানিটির অঘোষিত মালিক বনে গেছেন। খনি কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ৫ আগস্টের আগে যে ‘অল প্রাইম মিনিস্টার ম্যান’ পোস্ট দিয়েছিল, সেই এখন জুলাইয়ের পক্ষের লোক হিসেবে নিজেকে জাহির করছে। তিনি একই সাথে জিটিসির পরামর্শকের পদ দখল করে রেখেছেন এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন!!!

দুদক তদন্ত ও রহস্যজনক স্থবিরতা

মধ্যপাড়া খনিতে দুর্নীতির বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমামের ‘মধ্যপাড়া খনিতে পাথর উত্তোলনের নামে ৬০০ কোটি টাকা লোপাট’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মাধ্যমে। এরপর দুদক কাজী সিরাজসহ খনির ১৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে। অনুসন্ধানে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা চারটি মামলার সুপারিশ করেন।

তবে অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ ও দুদকের ভেতরের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে মামলাগুলো দুর্বল করে ফেলা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন করে নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এই দুর্নীতির ঘটনায় সাবেক সরকারপ্রধানসহ প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। এ কারণেই ’২৪-এর ৫ আগস্টের পর নতুন করে অনুসন্ধানের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

দ্বিতীয় চুক্তি : আরো অসম, আরো ভয়াবহ : সরকারি ক্রয়নীতির শর্ত উপেক্ষা করে ২০২১ সালে জিটিসির সাথে আবারো ছয় বছরের নতুন চুক্তি করা হয়। উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে এই চুক্তি সম্পাদন করা হয়, যার আওতায় ৮৮.৬ লাখ মেট্রিকটন পাথর উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। চুক্তির মূল্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রায় ১১৮.৬ মিলিয়ন ডলার এবং দেশীয় মুদ্রায় ২৬৬.৭ কোটি টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, কাজ সম্পাদন না করেও জিটিসি এই দ্বিতীয় চুক্তির আওতায় ইতোমধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থ তুলে নিয়েছে। পাশাপাশি ভুয়া বিল তৈরি করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা চলছে। খনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাসিনার আমলে জিটিসি এতটাই শক্তিশালী মাফিয়া হয়ে উঠেছিল যে, কোম্পানির কোনো কর্মকর্তার মতামত তার মতের সাথে অমিল হলেই বা অন্যায্য-ভুয়া বিল তুলতে তাকে সহায়তা না করলে তাকে অন্যত্র বদলি করে বা পদোন্নতি আটকে দিয়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই মাফিয়া ঠিকাদার জিটিসি প্রথম চুক্তি থেকে দ্বিতীয় চলমান চুক্তি পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ও তাদের দুর্নীতিতে সহায়তা না করায় অন্যত্র বদলি ও নানাভাবে অপদস্থ করেছে।

অবিক্রীত পাথর ও উৎপাদন সঙ্কট

মধ্যপাড়া খনির উৎপাদিত পাথরের প্রধান ক্রেতা (৫১ শতাংশ) বাংলাদেশ রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে মেগা প্রকল্পে দেশীয় পাথর খনি থেকে পাথর না কিনে ভারত থেকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে পাথর আমদানি করে। এভাবে আমদানিকৃত পাথরের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় খনি থেকে পাথর ক্রয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। বর্তমানে খনির ২৫টি স্ট্যাকইয়ার্ডে প্রায় ১২ লাখ টন পাথর অবিক্রীত পড়ে আছে, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। বিপুল এই মজুদের কারণে সংরক্ষণ ও বিক্রয় সঙ্কটে খনির উৎপাদন কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

উদ্ধার না ধ্বংস-সিদ্ধান্তের মুখে মধ্যপাড়া : ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশবিরোধী ও অসম চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে বাস্তবে প্রক্রিয়া ধীরগতির। অভিযোগ রয়েছে, পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ভেতরে এখনো পুরনো দোসররা সক্রিয় থেকে রাষ্ট্রীয় খনিকে অকার্যকর প্রমাণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে আবারো পুরো ব্যবস্থাপনা বেসরকারি মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয়া যায়।

মধ্যপাড়া খনি আজ কেবল একটি খনির গল্প নয়; এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট, প্রশাসনিক দখলদারিত্ব ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার এক করুণ দলিল। এখন প্রশ্ন একটাই- এই খনি কি সত্যিই উদ্ধার হবে, নাকি লুটের স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে?