আবারো ভাঙা হবে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে

পরিকল্পনাহীন উন্নয়নে অপচয় হাজার কোটি টাকা

Printed Edition

শফিকুল আলম ভূঁইয়া রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)

মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি লাইন-১ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের কাজের জন্য আবারো ভাঙা হবে পূর্বাচল এক্সপ্রেস ওয়ে। মেট্রোরেল কর্তৃপ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড এ এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে উড়াল এলিভেটেড রেললাইন নর্দ্দা থেকে রূপগঞ্জের কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত নির্মাণ করবে। এক্সপ্রেসওয়েতে মোট সাতটি মেট্রোরেল স্টেশন নির্মিত হবে।

স্টেশন ও পিলারের কাজ করার সময় রাস্তার মাঝখানের ফাঁকা জায়গা ব্যবহার করার কথা বলা হলেও, প্রকল্পের পরিচালক স্বীকার করেছেন যে রাস্তার কিছু অংশ তিগ্রস্ত হবে, যা পরবর্তীতে ঠিক করা হবে। রাজউক যখন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয়ে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ করেছে, ঠিক তখনই মেট্রোরেল কর্তৃপ একই পথে কাজ শুরু করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি প্রকল্প শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরেকটি প্রকল্পের কাজ শুরু করা, যেখানে প্রথমটিকে ভাঙতে হবে, তা অমার্জনীয় অপরাধ। বারবার ভাঙা ও ব্যয়বৃদ্ধি পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে বা পূর্বাচর উপশহর সড়কের নির্মাণের শুরু থেকেই পরিকল্পনার ত্রুটির কারণে কয়েক ধাপে জনগণের অর্থের অপচয় হয়েছে।

২০০৫ সালে যখন প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়, তখন এটি আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু তহবিলের স্বল্পতার কারণে ২০১৩ সালে মাত্র চার লেনের সড়ক তৈরি করা হয়, যার পেছনে প্রায় ২৭৬ কোটি টাকা বা তারও বেশি ব্যয় হয়েছে। কাজ প্রায় শেষ হওয়ার মুখে আবার সিদ্ধান্ত পাল্টানো হয় যে, চার লেনের রাস্তা যথেষ্ট নয়। চার লেনের রাস্তা ভেঙে এটিকে আবার আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে, ছয় লেনের সার্ভিস রোড এবং উভয় পাশে ১০০ ফুট চওড়া খালসহ একটি দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হিসেবে পুনর্নির্মাণ করা হয়।

এ পুনর্নির্মাণের কারণে প্রকল্পের ব্যয় আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়ায়। প্রাথমিক ৫,২৮৬ কোটি টাকার বরাদ্দ থেকে তা বেড়ে ১০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা বা কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী ১৪ হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়। চার লেনের জন্য ব্যয় করা অর্থ ও সময় পুরোটাই নষ্ট হয়।

বিশেষজ্ঞদের তীব্র সমালোচনা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক, যারা এ সমন্বয়হীনতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, একই সময়ে একটি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং আরেকটির ভাঙার কাজ শুরু করা একবিংশ শতাব্দীতে অমার্জনীয় অপরাধ। এতে জনগণের অর্থ ও কর্মঘণ্টার বিপুল অপচয় ঘটছে।

মাত্র ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কে এক্সপ্রেসওয়ে করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যার দুই প্রান্তে আবার সরু রাস্তা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘বাবুগিরি’ বা ‘অদূরদর্শী’ চিন্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এর কারণে প্রায় ৫২৪ কোটি টাকা তি হয়েছে বলে হিসাব করেছেন।

টিএনসিসি প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মহসীন উদ্দিন বলেন, যদি মেট্রোরেলটি ভূগর্ভস্থ করা হতো, তবে খরচ কিছুটা বাড়লেও পূর্বাচল উপশহর এর আইকনিক অবকাঠামো রা করা যেত এবং জনদুর্ভোগ এড়ানো যেত। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত যেভাবে আন্ডারগ্রাউন্ডে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে, একই পদ্ধতিতে কুড়িল থেকে এটি ভূগর্ভস্থ করা সম্ভব। এতে রাস্তা কাটা-ছেঁড়ার জন্য যে খরচ হবে, ভূগর্ভস্থ করার খরচও প্রায় একই হবে।

ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেএের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়কোবাদ আহমেদ জানিয়েছেন, তারা এখনো প্রকল্পের নকশা পর্যালোচনা করছেন এবং একটি বিকল্প সারিবদ্ধতা বিবেচনা করছেন, যেখানে বাম পাশ দিয়ে গেলে রাস্তা ভাঙার প্রয়োজন কম হবে। তিনি আরো জানান যে, এ সড়কটি ভাঙলে নতুন করে মেরামত করতে হবে এবং বর্তমানে একটি ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ চলছে।

বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ৩০০ ফুট সড়কের আশপাশের জলাধার ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে তিগ্রস্ত হবে। এ অপরিকল্পিত এবং সমন্বয়হীন প্রকল্প রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করবে এবং পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে বা ৩০০ ফুট সড়ক এ ধরনের পরিকল্পনার একটি দৃষ্টান্ত হতে যাচ্ছে।