‘ভবিষ্যৎ সরকারি দল’ এমন বিবেচনায় বিএনপির সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে চীন। গণ-অভ্যুত্থানের পর গত প্রায় এক বছরে চীন কেবল বিএনপির দুইটি হাইপ্রোফাইল টিমকেই নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়নি, ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতও দলটির সাথে গড়ে তুলেছেন এক ধরনের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ। চীনের সাথে এই সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসকে দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক হিসেবেই দেখছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে বলেছেন, এই সম্পর্ক কেবল দুইটি দেশের মধ্যেই নয়, বরঞ্চ এই সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ তৈরিতেও সহায়ক হবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কূটনীতিতেও কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। প্রভাবশালী দেশগুলো কিংবা উন্নয়ন সহযোগীরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র কেমন হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন। আগামী দিনের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথেও তারা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন, করছেন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মতবিনিময়। গত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের কূটনীতি ছিল মূলত ভারতমুখী। আগামীতে সেই সম্পর্কে বৈচিত্র্য আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীন সবসময়ই এ ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
গত প্রায় এক বছরে বিএনপির সাথে চীন যেভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিবিড় করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে অতটা দৃশ্যমান হয়নি। চীন বিএনপির দুইটি হাইপ্রোফাইল টিমকে ইতোমধ্যে নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সর্বোচ্চ সংবর্ধনা দিয়েছে। এই টিম দুইটির একটির নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যে টিমে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির আরো তিনজন সদস্য ছিলেন। অন্যটির নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। এই দুইটি টিমকে চীন এমন গুরুত্ব দিয়েছে, যেটিকে বিএনপির প্রতিনিধিদলে থাকা একজন নেতা ‘রাষ্ট্রীয় ভিজিট’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গত ২২ জুন বিএনপি মহাসচিবের নেতৃত্বে দলের উচ্চপর্যায়ের ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধিদল বেইজিংয়ে ‘গ্রেট হল অব পিপলে’ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য এবং ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লি হংজং, সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী মিস্টার লিউ জিয়ানচাও, সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার সান হাইয়ানের সাথে বৈঠক করে। এ ছাড়া চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার সুং-ওয়ে-ডং এর সাথে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব। বিএনপির প্রতিনিধিদল সানজি প্রদেশের রাজধানী জিয়াং এ বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বি ওয়াই ডি, হাইটেক প্রযুক্তি পার্ক, জিয়াংটং বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন, সানজি প্রদেশে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং জিয়ান শহরে একটি আদর্শ গ্রাম পরিদর্শন করেন। মির্জা ফখরুলের সাথে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লি হংজংয়ের বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে চীন সফরে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণও জানানো হয়। চীন সফর শেষ করে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচিত সরকারের সাথে চীন আরো গভীরভাবে কাজ করার অপেক্ষায় আছে। তিনি জানান, বিএনপি এক চীন নীতিতে বিশ্বাসী। এই নীতি থেকে তারা কখনো সরে যাননি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, চীন সফরে আমাদের পক্ষ থেকে পারস্পারিক মর্যাদা সমুন্নত রেখে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভাবনায় এমন সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছি যেখানে জনগণ এবং জনকল্যাণের অগ্রাধিকার যেন থাকে সর্বোচ্চ স্থানে। একই সাথে আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিবেচনায় নির্যাতিতদের পক্ষে চীনের অবস্থানকে আমরা সম্মানের সাথে অভিনন্দিত করেছি এবং এর ব্যাপকতা দৃশ্যমানতার আহ্বান জানিয়েছি। চীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দুই বছর মেয়াদি রাজনৈতিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে সফরোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছি।’
এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেন। যে টিমে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রপ্রতিনিধি ছিলেন। এই সফরেও বিএনপির প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।
চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের দুইটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড. মঈন খান। তিনি বলেন, প্রথমত: স্বাধীনতার সময়ে চীনের সাথে বাংলাদেশের একটি বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের সাথেও চীনের কোনোরকম কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নতুন করে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপন করেন। দ্বিতীয়ত, এটা সর্বজনবিদিত যে আধুনিক চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকে একটি দেশের সরকারের সাথে এবং চীনের রাজনীতি হচ্ছে ‘পলিটিক্স অব ইকোনমি’।
তিনি বলেন, চলমান ক্রান্তিকালীন সময়ে বিশেষ করে একটি বিশাল অর্থনৈতিক ও পরাশক্তিধর চীন উপলব্ধি করেছে যে, আগামীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এ দেশে জনগণের ভোটে বিএনপি সরকার গঠন করবে। আমরা মনে করি, এই বিবেচনায় আগামীতে চীন এ দেশের সম্ভাব্য সরকারের সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চায়। বিগত মাসগুলোতে তারা সম্পর্ক জোরদার করেছে। তাদের যে উন্নয়ন সহায়তা রয়েছে, তা তারা অব্যাহত রেখেছে। এ দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সরকার এলে জনগণের প্রতি চীনের সহযোগিতার হাত প্রসারিত থাকবে। এর ভিত্তিতে আগামীতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ধারিত হবে।