দ্য ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণ

আ’লীগের অস্থিরতার রেসিপিতে নির্বাচনী ঝুঁকি বাড়ছে

২০২৪ সালের ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহের পর বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনের ঝুঁকি অনেক

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition

পলাতক শেখ হাসিনার সমর্থকরা, বিশেষ করে তার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা- তার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হাসিনার ছেলে এবং প্রধান উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি বলেছেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য যদি তার মায়ের দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হয় তাহলে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা নির্বাচন বন্ধ করে দেবে।

জয় দাবি করেছেন, তিনি ও হাসিনা দেশের অভ্যন্তরে তার দলের সকল নেতাকর্মীর সাথে যোগাযোগ রাখছেন এবং ব্যাপক বিক্ষোভ এবং সম্ভাব্য সংঘর্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। জয় বলেছেন, দলের “লাখ লাখ কর্মী” ও “লাখ লাখ সমর্থক”একত্র হতে প্রস্তুত। তিনি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ব্রিশি সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে বলেন, “ব্যাপক বিক্ষোভ হবে... সংঘর্ষ হবে।”

বাংলাদেশ থেকে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের অস্থিরতা সৃষ্টির এই হুমকি দেশটিতে ইতোমধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জটিলতার একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দেশ আসন্ন নির্বাচনের যত কাছাকাছি আসছে- বিভিন্ন ফ্রন্টে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবল আওয়ামী লীগের সথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যেই সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে এমন নয় বরং পতিত দলটির পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে- বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে।

একই সাথে হাসিনার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করার ফলে মূূল প্রতিদ্বন্দি¦তায় থাকা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে তীব্র সঙ্ঘাতের আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। যদিও এ দু’টি দল অতীতে হাসিনার বিরোধিতায় প্রায়ই সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল। তারা এখন ক্ষমতা ও প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। হাসিনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। তা ছাড়া বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভাজন অস্থিরতাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।

নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে- দলগুলোর মধ্যে, স্ব স্ব দলের মধ্যে এবং রাজনৈতিক বিভাজনের বাইরে এই বহুস্তরীয় দ্বন্দ্ব বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক বিভাজন যতই গভীর হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সংঘাতের সতর্কবার্তা আরো অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তাই পরিস্থিতিকে আরো বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়া ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। যদি এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সাবধানতার সাথে পরিচালিত না হয়, তবে এগুলো কেবল নির্বাচন ব্যাহত করবে না বরং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।

আসন্ন নির্বাচনগুলো দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার সক্ষমতার একটি পরীক্ষা। তবে, আরো ইতিবাচকভাবে- ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ওপর গণভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের সুযোগ নিয়ে এই নির্বাচন কেবল একটি নতুন সরকার নির্বাচনের জন্য নয় বরং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যপটের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণের জন্যও।

জাতি যখন এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বিশ্বের মনোযোগ বৃহত্তর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতার ওপর নিবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি আগে কখনো এত বেশি ছিল না।

বাংলাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এবং গণভোটের তারিখ ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে সংশয় অনেকটা কেটে গেছে। এরপরও আওয়ামী লীগের হুমকিতে কি অস্থিরতা আসবে? এ প্রশ্ন এখন জনমনে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৬ তারিখে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ওপর গণভোটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা।

এই নির্বাচন দেড় বছরের রূপান্তরমূলক ঘটনার পর অনুষ্ঠিত হবে, যার শুরু ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন এক বিশাল বিদ্রোহের মাধ্যমে। যেই বিদ্রোহ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ভারতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিল। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দেশ প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের একটি নতুন যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নির্বাচনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ-ভোটাররা কেবল নতুন আইন প্রণেতাদের নির্বাচন করবেন না বরং জুলাই সনদ নামে পরিচিত একটি প্রস্তাবিত সংস্কার প্যাকেজের ওপর গণভোটেও অংশগ্রহণ করবেন। ২০২৪ সালের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই রাষ্ট্রীয় সংস্কার পরিকল্পনায় নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জোরদার এবং নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিস্তৃত প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংস্কারগুলোর লক্ষ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অপব্যবহার রোধ করাও, যা পূর্ববর্তী প্রশাসনের সময় বিতর্কের বিষয় ছিল।

ধারণাটি হলো, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে জনগণের প্রতি আরো প্রতিক্রিয়াশীল এবং জবাবদিহি করতে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহের দাবি পূরণ করা। কিন্তু গণভোট নিজেই কিছু বিতর্কের উৎস।

নির্বাচন পদ্ধতি

২০২৬ সালের সাধারণ নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ১২৭.৬ মিলিয়ন যোগ্য ভোটার তাদের ভোট দেবেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, প্রবাসী বাংলাদেশীরা ডাক ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই পদক্ষেপকে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তি এবং ভোটারদের অংশগ্রহণ সম্প্রসারণের দিকে একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এ ছাড়াও, আসন্ন নির্বাচনের জন্য ভোটদানের সময় আট থেকে নয় ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। এই সংস্কারগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ।

নির্বাচনের নিরাপত্তা আরো জোরদার করার জন্য, নিয়মিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি সামরিক কর্মীদের মোতায়েন করা হবে এবং হাসিনার শাসনামলে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

প্রধান দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে ইউনূস নির্বাচন এবং গণভোটকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় একটি “গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক” হিসেবে প্রশংসা করেছেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে নির্বাচন আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পথ প্রশস্ত করবে, যা দেশের গভীর রাজনৈতিক বিভাজনগুলোকে নিরাময় করতে পারে। ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু হবে, যা হাসিনার নেতৃত্বে পূর্ববর্তী নির্বাচনের সম্পূর্ণ বিপরীত।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (জেআই) এবং জাতীয় নাগরিক দলসহ (এনসিপি) প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ঘোষণার প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচনে ব্যাপকভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে, বিএনপি ও হাসিনার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ক্ষমতার বিনিময় করেছে।

হাসিনার অধীনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিষিদ্ধ করা ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক অঙ্গনে পুনরায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এনসিপি একটি নতুন দল, যা ২০২৪ সালের বিদ্রোহে জড়িত ছাত্র নেতাদের দ্বারা গঠিত। বিক্ষোভে একটি বিশিষ্ট শক্তি হওয়া সত্ত্বেও, দলটি ভোটারদের মধ্যে তার অবস্থান সুসংহত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আশা করা হচ্ছে যে তাদের রাস্তার শক্তিকে নির্বাচনী সমর্থনে রূপান্তরিত করতে তাদের লড়াই করতে হবে।

অন্য দিকে হাসিনার দল ঘোষণাটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে ইউনূস সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন না। হাসিনার নেতৃত্বে বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আধিপত্য বিস্তারকারী আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যার ফলে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছিল না।

জুন মাসে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যার মধ্যে ছাত্র বিদ্রোহের সময় নৃশংসতার অভিযোগও রয়েছে।

সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে জটিল হয়ে পড়েছে এবং বাংলাদেশ অস্থিরতার হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে।