বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক (রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ) কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন খবরে দেশের রফতানি খাতে নেমে এসেছে স্বস্তির বাতাস। অন্যদিকে বৈশ্বিক বাণিজ্য বাস্তবতায় কৌশলগত প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তাও সামনে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে ৭ আগস্ট থেকে।
গতকাল হোয়াইট হাউজের এক ঘোষণায় জানানো হয়, ৩৫ শতাংশ থেকে শুল্কহার কমিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর এখন ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে। ভারতের ক্ষেত্রে এই শুল্ক ২৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের জন্য ২০ শতাংশ রাখা হয়েছে।
চলতি বছরের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমবারের মতো বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ঘাটতির অভিযোগ এনে ওই সময় বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। পরে ৯ এপ্রিল তিন মাসের জন্য শুল্ক স্থগিত রেখে আলোচনার সুযোগ দেয়া হয়। পরে ১ আগস্ট থেকে ৩৫ শতাংশ আরোপের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
এই সময়কালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন সফর করে ব্যাপক আলোচনা করে। এসময় নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান এবং অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী। তাদের ধারাবাহিক আলোচনার ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নিয়ে এলো।
এদিকে হোয়াইট হাউজ জানায়, আদেশ কার্যকর হবে আদেশ স্বাক্ষরের সাত দিন পর, অর্থাৎ ৭ আগস্ট থেকে। তবে যেসব পণ্য এই সময়ের আগে জাহাজে উঠানো হয়েছে এবং ৫ অক্টোবরের মধ্যে গুদাম থেকে ছাড় করা হবে, সেগুলোর ওপর নতুন শুল্ক কার্যকর হবে না। শুল্ক কমানো হলেও নতুন ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের সাথে পূর্ববর্তী গড় ১৫ শতাংশ শুল্কযুক্ত থাকায় মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। তবে এটি আগের একক ৩৭ শতাংশ শুল্কের তুলনায় কিছুটা সহনীয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য বিশেষ করে গম ও তুলা কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া সাম্প্রতি ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার বিষয়ে আলোচনার খবরও এসেছে, যা মার্কিন কৃষি ও এভিয়েশন খাতের জন্য ইতিবাচক বার্তা। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তৈরী পোশাক শিল্পকে রক্ষা করা এবং সেটি আমরা পেরেছি। এ সিদ্ধান্ত লাখ লাখ শ্রমিকের জন্য একটি সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে আমাদের শুল্কহার এখন প্রায় সমান অথবা কিছুটা কম; এটি আমাদের জন্য স্বস্তির খবর।’ তবে তিনি সতর্ক করে দেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বায়াররা এখন প্রায় ২০ শতাংশ বেশি শুল্ক দেবে, ফলে প্রাথমিকভাবে রফতানিতে কিছুটা ধাক্কা লাগতে পারে।’
তিনি বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে গত তিন মাস ধরে আমরা একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন। মার্কিন ক্রেতারাও পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ৩৫ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়াটা আমাদের জন্য স্বস্তির। তিনি বলেন, দেশের ব্যবসায়ীরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের পণ্যে পাল্টা শুল্ক বেশি হলে ব্যবসা কঠিন হয়ে যাবে। তবে প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের পাল্টা শুল্ক ১ শতাংশ বেশি হলেও ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া চীনের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। তাই এটি আমাদের জন্য বড় স্বস্তির।
তিনি বলেন, বাড়তি পাল্টা শুল্কের কারণে সাময়িকভাবে ব্যবসা কমতে পারে। তার কারণ আগের থেকে পণ্য আমদানিতে বেশি শুল্ক দিতে হবে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে। এতে তাদের মূলধনে টান পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে তারা যদি বাড়তি অর্থায়নের সংস্থান না করতে পারে, তাহলে ক্রয়াদেশ কম দেবে। তা ছাড়া বাড়তি শুল্ক শেষ পর্যন্ত ক্রেতাদের ঘাড়ে গিয়েই পড়বে। শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়লে ক্রেতারা চাপে পড়বেন। তাতে পণ্যের বিক্রি কমে যেতে পারে।
বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট বলেন, চীনের ওপর এখন পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আছে ৩০ শতাংশ। শিগগিরই দেশটির ওপর চূড়ান্ত পাল্টা শুল্কহার ঘোষণা করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে যত দূর আভাস মিলছে, তাদের শুল্কহার আমাদের চেয়ে কম হবে না। ফলে দিন শেষে চীন থেকে তৈরী পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হওয়া অব্যাহত থাকবে। তাতে আমাদের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ আসবে। সে ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মতো বিষয়গুলো অনুকূলে থাকতে হবে বলে তিনি জানান। এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এটা জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়, বরং একটি তুলনামূলকভাবে সন্তোষজনক অবস্থান। তিনি বলেন, শুল্ক ছাড়ের বিনিময়ে আমরা কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেটি পরিষ্কার নয়। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের উন্মুক্ত করে বলা উচিত।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার পর ভারতের টেক্সটাইল কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে বড় ধরনের পতন দেখা দেয়। গোকুলদাস এক্সপোর্টস, পার্ল গ্লোবাল, কেপিআর মিল, ওয়েলস্পান লিভিংসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারে ৩ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত পতন হয়। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের তুলনামূলক কম শুল্কহার ভারতের পোশাক রফতানিকারকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মার্কিন বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, শুল্ক কমানো একটি ভালো সিদ্ধান্ত হলেও আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। তার মতে, বিশ্ববাণিজ্যে চীনের ওপর কী ধরনের শুল্ক আরোপ করা হবে, সেটি চূড়ান্ত হলে তখনই বোঝা যাবে আসল প্রতিযোগিতা কাদের সাথে। চীন যদি স্বল্প শুল্ক সুবিধা পায়, তাহলে প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে। তিনি আরো বলেন, এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি কৌশলগত দিক স্পষ্ট হয়। এক, রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো; দুই, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি; এবং তিন, নতুন মুক্তবাণিজ্য চুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বার্ষিক রফতানি প্রায় আট বিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশ তৈরী পোশাক খাত। বিপরীতে আমদানি মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের মতো। অর্থাৎ রফতানির ভারসাম্য বাংলাদেশের পক্ষেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তবে শুল্ক ছাড়ের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তির বিস্তারিত এখনো প্রকাশ হয়নি। কী প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, আর কী লাভের আশা করা হচ্ছে সেসব নিয়েই এখন অর্থনীতি ও কূটনীতিক মহলে আলোচনা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের শুধু ট্যারিফ হ্রাসের কারণে রফতানি বেড়ে যাবে এমনটা না। আমাদের কিছু মৌলিক সমস্যা আছে, বিশেষ করে সরবরাহ ব্যবস্থার দিক থেকে, সেগুলো ঠিক করতে হবে। তাহলেই আমরা এই সুযোগগুলো বাস্তবে কাজে লাগাতে পারব। শুরু থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে ভারত। শুধু গার্মেন্টস না, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জুতা, প্লাস্টিকসহ আরো বেশ কিছু পণ্যে ভারত আমাদের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। ধারণা করা হয়েছিল ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ১ শতাংশ দখল করে ফেলবে। যদি আমাদের ট্যারিফ ৩৫ শতাংশ আর ভারতের ২৬ শতাংশ হতো তাহলে পরিস্থিতি আমাদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে যেতো। তবে এখন দৃশ্যপট বদলেছে। ভারতের ট্যারিফ ২৫ শতাংশ করা হয়েছে, সাথে রয়েছে পেনাল্টি, যা প্রায় ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ভারতের ওপর কোনো অতিরিক্ত চাপ বা পেনাল্টি না-ও থাকত, তবুও আমাদের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাল্টা শুল্ক কমানোর ফলে আপাতত রফতানি খাত কিছুটা স্বস্তি পেলেও এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত সতর্কবার্তা। বাণিজ্যনির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প বাজার খোঁজা, পণ্যের বৈচিত্র্য আনয়ন এবং নীতিগত স্বচ্ছতা বৃদ্ধিই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য টেকসই পথ।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান আলোচক ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত সতর্কভাবে আলোচনা করেছি, যাতে আমাদের প্রতিশ্রুতি আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করাই ছিল আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার, তবে আমরা মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতির দিকেও মনোযোগ দিয়েছি। এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সাথে সৌহার্দ্য তৈরি করবে।’
খলিলুর রহমান আরো বলেন, আজ আমরা একটি সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়াতে সক্ষম হয়েছি। এটি আমাদের পোশাক খাত এবং এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুখবর। আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা অক্ষুণ্ন রেখেছি এবং বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি।