বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকের পাশাপাশি ফাইন্যান্স কোম্পানি বা লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। করপোরেট খাতে ঋণ সরবরাহ, শিল্প খাতে বিনিয়োগ, গাড়ি ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সহায়তা-এসবের মাধ্যমে খাতটি অনেক বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর চিত্র ভয়াবহভাবে বদলে গেছে। এক দিকে লাগামহীন লুটপাট, অন্য দিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় খাতটি এখন মারাত্মক সঙ্কটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদের চেয়ে দায় বেড়ে গেছে। সম্পদ যেখানে ১০০ টাকা, দায় সেখানে বেড়ে হয়েছে ১১২ টাকা। মূলধন শূন্য হয়ে দেউলিয়ার পথে এখন প্রায় ডজনখানেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
খেলাপি ঋণে জর্জরিত খাত
ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা, যা মোট লিজিং বা বিনিয়োগের ২৩.৮৮ শতাংশ। কিন্তু মাত্র তিন মাস পর, ২০২৩ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এ সময় খেলাপির হার দাঁড়ায় ৩৫.৩২ শতাংশ। মার্চের পর এ অঙ্ক আরো বেড়েছে। এ খেলাপি ঋণের বড় অংশই জামানতবিহীন। দুর্বল ২০ কোম্পানির মধ্যে ৮টির খেলাপি ঋণ প্রায় শতভাগ, আর বাকিগুলোর খেলাপি ঋণ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ তারা যে ঋণ দিয়েছে তার অধিকাংশই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মূলধন ক্ষয়ে অস্তিত্ব সঙ্কট
প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নির্দিষ্ট হারে মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজন ১০ শতাংশ, তবে ১২ শতাংশ হলে খাতের জন্য আরো নিরাপদ ধরা হয়। কিন্তু ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর গড় মূলধন সংরক্ষণের হার নেমে এসেছে ভয়াবহ পর্যায়ে। ২০২৩ সালের মার্চে মূলধন সংরক্ষণে ঘাটতি ছিল মাত্র ৩.২৪ শতাংশ। একই বছরের জুনে মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ৩.৩১ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৪৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের মার্চে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ঘাটতি পৌঁছে যায় ২০.৫৮ শতাংশে। এমন অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যত মূলধনশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে বিনিয়োগ থেকে আয় না হয়ে উল্টো লোকসান হচ্ছে।
সম্পদ ও দেনার ভারসাম্যহীনতা
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর মোট দেনা দাঁড়িয়েছে এক লাখ দুই হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সম্পদের পরিমাণ সামান্য বেশি, প্রায় এক লাখ কোটি টাকার কিছুটা ওপরে। এ অবস্থায় দুর্বল ২০ কোম্পানি নতুন কোনো আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। বিদ্যমান আমানত ফেরত দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। অনেক কর্মী মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না।
রাজনৈতিক প্রভাব ও লুটপাট
ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর পতনের পেছনে বড় কারণ রাজনৈতিক প্রভাব ও লুটপাট। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ খাতে নজিরবিহীন অর্থ লুট হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম পি কে হালদার। তিনি একাই পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন এবং এর বড় অংশ বিদেশে পাচার করেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এস আলম গ্রুপসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বিপুল অর্থ লুট করেন। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, ১১টি ফাইন্যান্স কোম্পানি আর পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই। এগুলো কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে। তবে বাকি কোম্পানিগুলো উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ, নতুন মূলধন সংযোজন ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর নির্ভর করে বাঁচার সুযোগ পেতে পারে। বর্তমানে ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টিকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠান ‘অতি দুর্বল’ তালিকায় রয়েছে।
খাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সঙ্কট শুধু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নয়, বরং সার্বিক অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত : দুর্বল প্রতিষ্ঠানের অনেক আমানতকারী টাকা তুলতে পারছেন না। নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না কর্মচারীরা। আস্থার সঙ্কটে নতুন বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীরা এ খাতে আসতে চাইছেন না। খাতটি মূলত শিল্প, এসএমই ও অবকাঠামো খাতে অর্থায়ন করে থাকে। এ খাতের দুর্বলতা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধীর করছে। এতে অর্থনীতিতে চাপ বেড়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ফাইন্যান্স কোম্পানি খাত একসময় আর্থিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কিন্তু লাগামহীন লুটপাট, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও ঋণ খেলাপির কারণে খাতটি এখন ভঙ্গুর অবস্থায়। মূলধন ঘাটতি, সম্পদের ঘাটতি এবং দায়বদ্ধতার চাপে অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার পথে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ, দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি এবং নতুন মূলধন সংযোজন ছাড়া এই খাতকে টেনে তোলা প্রায় অসম্ভব। অন্যথায় একে একে প্রতিষ্ঠানগুলো ধসে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে গোটা অর্থনীতিতেই।