নারায়ণগঞ্জ শহরের নতুন যন্ত্রণা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। নিয়মিত অভিযান চালালে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশা রাস্তায় নামার সুযোগ পেত না। অথচ এসব অনিয়ম চোখের সামনে ঘটলেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন। তাদের মতে, কাজ করতে না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দিন, অন্য কাউকে দায়িত্ব দিন।

কামাল উদ্দিন সুমন, নারায়ণগঞ্জ
Printed Edition
চাষাঢ়া মোড়ে যানবাহনের জটলা
চাষাঢ়া মোড়ে যানবাহনের জটলা |নয়া দিগন্ত

  • নিবন্ধন ১৭ হাজার ৩০০ চলছে অর্ধলাখ
  • একই রেজিস্ট্রেশনে একাধিক গাড়ি

নারায়ণগঞ্জ শহর এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দখলে। নগরবাসীর অভিযোগ- মানুষের চেয়ে রাস্তায় মিশুকের সংখ্যা যেন বেশি। রেজিস্ট্রেশনের অজুহাত দেখিয়ে অটোরিকশা মালিকরা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এর ফলে যানজট, জনভোগান্তি আর বিশৃঙ্খলা নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আসলে কোথা থেকে আসছে এত অটোরিকশা?

তথ্য বলছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭ হাজার ৩৪২টি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে। অথচ বাস্তবে শহরে চলছে অন্তত ৪৫ হাজারের বেশি মিশুক। চালকদের দাবি, তাদের যানবাহন রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত। তবে, অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে একাধিক অটোরিকশা সড়কে চলছে। অসাধু মালিকরা একটি নম্বার কপি করে ৮-১০টি গাড়ির পেছনে লাগিয়ে অবাধে ব্যবসা করছে। রেজিস্ট্রেশন কার্ডগুলো দেখতে প্রায় অভিন্ন হওয়ায় আসল-নকল চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। এভাবেই তৈরি হয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট, যারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই জালিয়াতির কারণে প্রকৃত মালিকরাও আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। নিয়মিত অভিযান চালালে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশা রাস্তায় নামার সুযোগ পেত না। অথচ এসব অনিয়ম চোখের সামনে ঘটলেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন। তাদের মতে, কাজ করতে না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দিন, অন্য কাউকে দায়িত্ব দিন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি রহমান বিশ্বাস জানান, যানজট নিরসনের উদ্দেশ্যে আগে দেয়া রিকশার লাইসেন্স কনভার্ট করে মিশুকের নামে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু অসাধু ব্যক্তি সেই লাইসেন্স কপি করে রাতারাতি অসংখ্য অটোরিকশা নামিয়ে ফেলে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

তিনি বলেন, আমরা হাতে-নাতে একটি প্রিন্টিং প্রেসে জাল নম্বর প্লেট বানাতে দেখে সাথে সাথে সিটি করপোরেশন ও থানায় খবর দিই। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এতে আমরা নিরাশ হয়েছি। রহমান বিশ্বাসের শঙ্কা, নকল প্লেট প্রস্তুতকারীরা যে কোনো সময় প্রকৃত মালিকদের নম্বরও কপি করতে পারে। এমন হলে নিরপরাধ মালিকদের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তার মতে, অবিলম্বে সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি আশার কথা জানিয়ে বলেন, করপোরেশন ডিজিটাল নম্বর প্লেট চালুর চিন্তাভাবনা করছে। এটি হলে জাল নম্বর তৈরি করা সম্ভব হবে না। রংপুরে ইতোমধ্যে এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং কার্যকর প্রমাণিতও হয়েছে।

শহরের চাষাড়া, কালীবাজার, ২ নম্বর রেলগেট, জিমখানা ও নিতাইগঞ্জ মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মিশুক ও সিএনজি রাস্তায় সড়কে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। যত্রতত্র পার্কিং করে তারা যাত্রী উঠানামা করছে। ফলে প্রধান সড়কগুলোতে ভয়াবহ যানজট তৈরি হচ্ছে।

প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন শহরের একমাত্র চাষাড়া দিয়ে প্রবেশ ও বের হয়। ব্যবসায়িক নগরী হওয়ায় প্রতিদিন লাখো মানুষ শহরে আসে। অথচ অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে ওঠা অবৈধ অটোরিকশা ও সিএনজি স্ট্যান্ড শহরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সড়কের বিভিন্ন মোড়ে যত্রতত্র পার্কিং যানজটকে চরমে তুলছে।

নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশ জানিয়েছে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ফিটনেসবিহীন সিএনজি ও অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তারা শহরে যত্রতত্র পার্কিং বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে বাস্তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

অন্যদিকে, এসব অটোরিকশার বেপরোয়া চলাচলে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। পাশাপাশি বিদ্যুতের অবৈধ ব্যবহারও বাড়ছে। ব্যাটারিচালিত যানবাহন চার্জ দিতে গিয়ে অবৈধ সংযোগ নেয়ার কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

শহরবাসীর অনেকেই বলছেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখন আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যানজট, অন্যদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি- সব মিলিয়ে তারা প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন। নগরবাসীর প্রত্যাশা, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।