আ’লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না

মেহদি হাসানের সাথে সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা

আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে আচরণ করছে না। তারা মানুষ হত্যার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। তারা যা করেছে তার কোনো দায় নেয়নি। একটি শব্দও না। বরং, তারা সর্বদা অন্য কাউকে দোষারোপ করে।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক মেহদি হাসানের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রীয় সংস্কার, রোহিঙ্গা সঙ্কট, নির্বাচন প্রস্তুতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির নানা দিক নিয়ে খোলামেলা মতামত প্রকাশ করেছেন। গত সোমবার রাতে হাসানের মিডিয়া কোম্পানি জেটিও কথোপকথনের পাঁচ মিনিটের একটি ক্লিপ প্রচার করে। আল জাজিরার হেড টু হেডের উপস্থাপক হিসেবে পরিচিত হাসান বিশ্বনেতাদের তীব্র প্রশ্ন তুলে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত।

গণতন্ত্র ও নির্বাচন

মেহদি হাসান : সমালোচকরা বলছেন, আপনার সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নে ধীরগতি। আপনি কিভাবে জবাব দেবেন?

ড. ইউনূস : আমরা একটি ভাঙা রাষ্ট্রযন্ত্র পেয়েছি। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন সবকিছুই অবিশ্বাসের জায়গায় নেমে এসেছিল। আমরা ধাপে ধাপে সংস্কার করছি, যাতে জনগণ স্থায়ী ফল দেখতে পান।

মেহদি হাসান : জাতীয় নির্বাচন কি নির্ধারিত সময়ে হবে?

ড. ইউনূস : হ্যাঁ, ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন হবে। তবে শুধু সময় মেনে নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও আস্থার নির্বাচন নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। এ জন্য নতুন ভোটার তালিকা, ডিজিটাল ভেরিফিকেশন ও প্রবাসী ভোটাধিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

রোহিঙ্গা সঙ্কট

মেহদি হাসান : রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্কট এখনো ভয়াবহ। আপনি কী সমাধান দেখছেন?

ড. ইউনূস : এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে, যা গুরুতর সমস্যা। তবে আমি বারবার বলেছি, স্বদেশ প্রত্যাবাসন ছাড়া টেকসই সমাধান নেই। আমরা বিশ্বমঞ্চে চাপ বাড়াচ্ছি এবং ক্যাম্পে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। শিক্ষাহীন প্রজন্ম ভবিষ্যতে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

পররাষ্ট্রনীতি

মেহদি হাসান : ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সবাই বাংলাদেশকে প্রভাবিত করতে চায়। আপনার কূটনৈতিক অবস্থান কী?

ড. ইউনূস : আমাদের নীতি স্পষ্ট ‘বন্ধুত্ব সবার সাথে, নিরপেক্ষতায় স্থিতিশীলতা।’ আমরা কোনো শক্তির দিকে ঝুঁকছি না, বরং সবার সাথেই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখছি। বাংলাদেশ ছোট হলেও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, আমরা চাই কেউ যেন আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি করতে না পারে।

অর্থনীতি

মেহদি হাসান : রিজার্ভ সঙ্কট, বিনিয়োগ স্থবিরতা, বেকারত্ব এসব কিভাবে সামলাবেন?

ড. ইউনূস : আমরা অর্থনীতিকে স্বচ্ছ করেছি এবং তরুণ উদ্যোক্তা ও সামাজিক ব্যবসার মডেলকে এগিয়ে নিচ্ছি। একই সাথে বিনিয়োগবান্ধব আইন সংস্কার করছি। সময় লাগবে, তবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

ভারত প্রসঙ্গ

মেহেদি হাসান : বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে, বিশেষত ভারত থেকে।

ড. ইউনূস : বাংলাদেশে কোনো হিন্দু-বিরোধী সহিংসতা নেই। হিন্দু-বিরোধী সহিংসতা সম্পর্কে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর জন্য তিনি ভারতকে অভিযুক্ত করে বলেন, ভারতের বর্তমানে অন্যতম বিশেষত্ব হলো ভুয়া খবর।

মেহেদি হাসান : কেন নতুন নির্বাচনের জন্য আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?

ড. ইউনূস : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিনটি প্রাথমিক দায়িত্ব রয়েছে: সংস্কার, ন্যায়বিচার এবং নির্বাচন। তার মতে, স্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য এই কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে। সংস্কার ছাড়া, কেবল নির্বাচনই একই সমস্যা পুনরুৎপাদন করবে, কারণ আইন, ব্যবস্থা এবং কাঠামো অপরিবর্তিত থাকবে। তাই প্রশাসন কর্তৃত্ববাদের মূল হিসেবে যা বর্ণনা করেছেন তা ভেঙে ফেলা এবং অতীতের শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য একটি নতুন কাঠামো তৈরি করার দিকে মনোনিবেশ করছে। জনমত বিভক্ত। জনসংখ্যার একাংশ দ্রুত নির্বাচনের দাবি করলেও, অন্য অংশ বিশ্বাস করেন যে স্থিতিশীলতা এবং পরিষ্কার শাসনব্যবস্থাকে তাড়াহুড়ো করে ভোটের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। পরবর্তী মতামতের সমর্থকরা যুক্তি দেন যে দীর্ঘস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা দেশকে দুর্নীতি ও অস্থিতিশীলতার অতীত চক্রে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। বর্তমান প্রশাসনকে একটি বিস্তৃত ম্যান্ডেট দেয়া হয়েছে। সমালোচকরা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও, বাংলাদেশের কিছু কণ্ঠস্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে তাকে পাঁচ, দশ বা এমনকি পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

মেহেদি হাসান : বাংলাদেশের জনগণ আপনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে কিভাবে মনোনীত করল?

ড. ইউনূস : আমি অবাক হয়েছিলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলাম। সেই সময়ে আবেগপ্রবণ বিক্ষোভকারীদের বলেছিলাম, ‘যদি তোমরা এত ত্যাগ স্বীকার করে থাকো, তাহলে আমি আমার মত পরিবর্তন করব।’

মেহেদি হাসান : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যাবে কি না?

ড. ইউনূস : দলটি এখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না, তবে তারা একটি দল হিসেবে বৈধ থাকবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়নি, এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কেবল স্থগিত করা হয়েছে। এটি ভুল সমালোচনা কারণ আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি। তাদের কার্যক্রম কেবল স্থগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারবে না। ইউনূস অভিযোগ করেন যে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। (আওয়ামী লীগ) কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে আচরণ করছে না। তারা মানুষ হত্যার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। তারা যা করেছে তার কোনো দায় নেয়নি। একটি শব্দও না। বরং, তারা সর্বদা অন্য কাউকে দোষারোপ করে।

মেহেদি হাসান : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে কী বলেছিলেন?

ড. ইউনূস : আমি মোদির সাথে (তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে) কথা বলেছি। তিনি দু’টি কথা বলেছেন। প্রথমত, তারা বলেছেন, তারা তাকে রাখতে চান। আমি বলেছি আমরা আপনাকে বলতে পারছি না যে তার সাথে কী করতে হবে। তবে নিশ্চিত করুন যে তিনি আমাদের সম্পর্কে কথা বলবেন না। তিনি বাংলাদেশী জনগণের সম্পর্কে কথা বলবেন না। তিনি বলেন, যে সোশ্যাল মিডিয়া আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তারা তাকে সর্বদা সমর্থন করে আসছে। তারা এখনো আশা করছে যে তিনি পূর্ণ গৌরব নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে ফিরে আসবেন।

মেহেদি হাসান : সমালোচকরা বলছেন, আপনার সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নে ধীরগতি। আপনি কিভাবে জবাব দেবেন?

ড. ইউনূস : আমরা একটি ভাঙা রাষ্ট্রযন্ত্র পেয়েছি। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন সবকিছুই অবিশ্বাসের জায়গায় নেমে এসেছিল। আমরা ধাপে ধাপে সংস্কার করছি, যাতে জনগণ স্থায়ী ফল দেখতে পান।

ব্যক্তিগত প্রশ্ন

মেহদি হাসান : সমালোচকরা বলেন, আপনি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ নন। তাহলে কেন এই দায়িত্ব নিলেন?

ড. ইউনূস : ক্ষমতার জন্য আমি আসিনি। জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে এই দায়িত্ব দিয়েছে। আমার লক্ষ্য হলো অন্তর্বর্তীকালকে একটি সেতু বানানো, যেখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মর্যাদার পথে নতুন যাত্রা শুরু করবে।