৯ বছরেও পরিচয় মেলেনি হতভাগা ৪ যুবকের

গাজীপুরে ‘জঙ্গি’ নাটক সাজিয়ে হত্যা

এস এম মিন্টু
Printed Edition
গাজীপুরে কথিত ‘জঙ্গি বিরোধী’  অভিযানে নিহত অজ্ঞাত পরিচয় ৪ যুবক
গাজীপুরে কথিত ‘জঙ্গি বিরোধী’ অভিযানে নিহত অজ্ঞাত পরিচয় ৪ যুবক

গাজীপুরের পাতারটেকে পুলিশের ‘জঙ্গি’ নাটক সাজিয়ে সাতজনকে মুহুর্মুহু গুলি করে হত্যার ঘটনায় তিনজনের পরিচয় মিললেও হতভাগা বাকি চারজনের পরিচয় জানা যায়নি। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর সকাল আনুমানিক ৮টা ৫০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জয়দেবপুর থানার আফারখোলা পাতারটেক এলাকায় সোলাইমান সরকারের বাড়িতে পুলিশের বিশেষায়িত সিটিটিসি, সোয়াট টিম, গাজীপুর জেলা ও বগুড়া জেলা পুলিশ তথাকথিত যৌথ অভিযানের সময় পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ওই বাড়িতে ‘কথিত জঙ্গি’ নিধনের নামে শত শত গুলি করে সাতজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন ৯ অক্টোবর ডিএমপি মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো ইমেইল থেকে সাতজনের পরিচয় জানানোর জন্য অনুরোধ করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এরপর তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও হতভাগা চারজনের পরিচয় গত ৯ বছরেও জানা যায়নি।

বর্তমানে এই মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত চলছে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, যৌথ অভিযান পরিচালনাকালে কথিত সাতজনকে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের প্রত্যেকের বয়স ১৯ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের বরইতলা বাজারের আবু সাঈদের ছেলে ফরিদুল ইসলাম আকাশ (২৭), সুনামগঞ্জের ছাতকের মনিরগাথি (ডিকমা) গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম বাবলু (১৯) ও পুরান ঢাকার বংশালের মো: আজিম উদ্দিনের ছেলে ইব্রাহিম (১৮)।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমে বলেন, ‘যারা জঙ্গিদের লাশ চাইবে, তাদেরও নজরদারিতে রাখা হবে।’ এমন সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর পরিবারের নিরাপত্তা এবং হয়রানির ভয়ে অনেকেই স্বজনদের পরিচয় প্রকাশ করেনি। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর নিহত ইব্রাহিমের বাবা মো: আজিম উদ্দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেন। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্াইব্যুনালে মামলাটি তদন্তাধীন। উপরোক্ত ঘটনায় সাবেক আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক সিটিটিসি প্রধান মো: মনিরুল ইসলাম, বগুড়া জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো: আসাদুজ্জামান, গাজীপুরের সাবেক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্াইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করেন। মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অজ্ঞাতনামা চারজনের পরিচয় শনাক্ত করা জরুরি প্রয়োজন বলে মনে করেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের পরিচয় শনাক্ত হলে আত্মীয়-স্বজনদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থা, ঢাকার ধানমন্ডি অফিসে অথবা ০২-৪১০২০০২৬ টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

এদিকে ২০১৬ সালে ৮ অক্টোবর যে ‘জঙ্গি’ নাটকের ঘটনা সাজানো হয় তার মূল মাস্টারমাইন্ড গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান রেজার নাম মামলায় না থাকায় নিহত ও স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পাতারটেকে সরজমিনে সম্প্রতি নয়া দিগন্তে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের সময় স্থানীয়রা জানান, তৎকালীন সাবেক গাজীপুরের এসপি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান রেজা। তিনি পতিত আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াত-শিবির নিধনের অন্যতম কারিগর ছিলেন। বিএনপি মনোনীত তৎকালীন গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক মান্নানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে রেজাউল হাসানের বিরুদ্ধে। পাতারটেকে ‘জঙ্গি’ নাটকের ঘটনায় আন্তর্জাতিক ট্রইব্যুনালে করা মামলায় তৎকালীন ওসি রেজাউল হাসান রেজার নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এলাকাবাসী দাবি জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ দৈনিক নয়া দিগন্তে ‘গাজীপুরে দুই বাড়িতে কথিত উগ্রবাদী আস্তানা, সাতজনকে হত্যা করতে ৮৩০ রাউন্ড গুলি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইব্রাহিমের বাবা মো: আজিম উদ্দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেন। ওই মামলাটি বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।