২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবে রূপ নিতে না পারাকে দুর্ভাগ্যজনক বলছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, “স্বপ্নগুলো এখনো মরে যায়নি, কিন্তু মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেছে।”
নয়া দিগন্তকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আজকের নায়করা যদি ফ্যাসিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তবে কাল তারা ভিলেনে পরিণত হবেন।” তিনি ছাত্র রাজনীতিতে স্লোগাননির্ভরতা, অভিজ্ঞতাহীন উপদেষ্টা নিয়োগ এবং শিক্ষা সংস্কারে ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা করেন।
ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানীর এই সাক্ষাৎকার শুধু একজন বুদ্ধিজীবীর প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি চলমান বিপ্লবের নৈতিক ও দার্শনিক রূপরেখা। শিক্ষাব্যবস্থা, ছাত্ররাজনীতি, রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন এবং বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে তার বক্তব্য নিঃসন্দেহে আলোচনার সৃষ্টি করবে। এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাশিদুল ইসলাম।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের পর ছাত্রদের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর দায় কার?
ড. রব্বানী : ছাত্রদের দিকভ্রষ্ট করার পেছনে সরকারের দায় আছে। তারা ছাত্রদের দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে, অথচ ক্লাসরুমে ফেরত নেয়ার উদ্যোগ নেয়নি। অনেক ছাত্রকে উপদেষ্টা বানানো হয়েছে, যারা পড়াশোনা শেষ করেনি। এটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত।
নয়া দিগন্ত : ইউনূস সরকার আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়নে কতটা সফল?
ড. রব্বানী : পুরোপুরি ব্যর্থ। সরকার শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সিভিল প্রশাসন সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ইউনূস এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে বসেননি। মনে হচ্ছে, তিনি পুরো দেশকে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বানাতে চান।
নয়া দিগন্ত : ৫ আগস্টের ঐক্য কি ধরে রাখা যায়নি?
ড. রব্বানী : না, ৮ আগস্টেই তা ভেঙে পড়ে। স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সরকার সেটিকে ধরে রাখতে পারেনি। বরং বিশেষ গোষ্ঠী আন্দোলনের কৃতিত্ব কুক্ষিগত করেছে। এতে ছাত্রদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : আপনি ছাত্রদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের গন্ধ পাচ্ছেন বলছেন কেন?
ড. রব্বানী : ছাত্রদের মধ্যে স্লোগান নির্ভর রাজনীতি চলছে, গবেষণাভিত্তিক রাজনীতি নয়। এখনো তারা গবেষণা সেল গঠন করেনি, আন্তর্জাতিক চুক্তি বিশ্লেষণ করছে না, দিল্লি-বিরোধিতা করছে আবেগ দিয়ে- এই ধারা চললে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে।
নয়া দিগন্ত : বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা নিতে পারত?
ড. রব্বানী : বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ রাষ্ট্রকে রেক্টিফাই করা। সরকার চাইলেই ছাত্রদের নিয়ে একটি ছায়া-ক্যাবিনেট গঠন করতে পারত। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি মাসে একবার উপদেষ্টাদের সাথে মতবিনিময় করত। তখন নেতৃত্বের বিকাশ হতো, দায়িত্ববোধ জন্মাত।
নয়া দিগন্ত : তাহলে কি আপনি হতাশ?
ড. রব্বানী : দহন আছে, কিন্তু আশা এখনো জাগে। নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ওঃ রং ঃযব ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ড়ভ ঃযব রহঃবষষবপঃঁধষ ঃড় ংঢ়বধশ ঃযব ঃৎঁঃয ধহফ বীঢ়ড়ংব ষরবং. আমাদের সত্য বলতে হবে। আমরা যারা শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী তাদের দায়িত্ব আরো বেশি।
নয়া দিগন্ত : ছাত্রদের জন্য আপনার বার্তা কী?
ড. রব্বানী : ছাত্রদের বলব, ভুল করো না। ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং ২৪ সব ক’টায় ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়েছে। যদি এবার তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ রাস্তায় নামবে না। দীর্ঘস্থায়ী গুণগত পরিবর্তনের জন্য স্লোগান নয়, চাই জ্ঞানভিত্তিক লড়াই।
নয়া দিগন্ত : আপনার নিজের অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু বলবেন?
ড. রব্বানী : আমি বিশ্বাস করি, ২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছি। তার জন্য আমাকে হত্যা করা হলেও আপত্তি নেই। কারণ আমাদের সন্তানদের রক্ত আমাদের চেয়ে বেশি পবিত্র। সেই রক্তের মর্যাদা রক্ষা করাই আমার দায়িত্ব।
[সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত অংশ প্রকাশ হবে আগামীকাল]