আরফাত বিপ্লব চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম নগরের চট্টেশ্বরী রোডের পাশে একটি ভ্রাম্যমাণ টং দোকান। কেটলিতে টগবগ করে ফুটছে পানি, কাপে চিনি আর দুধের মিশ্রণ তৈরি করে চা বানাচ্ছেন এক যুবক। তার চোখেমুখে সংগ্রামী জীবনের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু এই সাধারণ চা বিক্রেতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বুক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর এক দশকের নির্মম রাজনৈতিক নিপীড়নের অমানবিক কাহিনী। আলেম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাদরাসায় ভর্তি হওয়া এই যুবকটি আজ অনার্স অসমাপ্ত রেখেই জীবনের তাগিদে চা বিক্রি করছেন।
১১ বছর আগেও চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতী ইউনিয়নের সাতগড় গ্রামের এলাকার বাসিন্দা ওমার ফারুক জাভেদের জীবনটা এমন ছিল না। ২০১২ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করে ইসলামী জ্ঞানার্জনের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৩ সালে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু তার স্বপ্নযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত হওয়া। তার অভিযোগ, গ্রামে তাকে দেখলেই একের পর এক মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
তার প্রাণোচ্ছল ছাত্রজীবনে দুঃস্বপ্নের শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি। গ্রামে এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তৎকালীন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মোক্তার হোছাইন মানিকের ইশারায় পুলিশ তাকে আটক করে। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর তার ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমার কোনো কথাই শোনেনি। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।’ জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন ৪ জন নতুন মামলার আসামি হিসেবে। আগে থেকেই তার নামে ৩টি মামলা ছিল। এই ৭ মামলার বোঝায় তার জীবনটা যেন থমকে যায়। ১০ দিনের রিমান্ডের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে কারাগার থেকেই তিনি আলিম পরীক্ষায় অংশ নেন। সেবার প্রায় পাঁচ মাস কারাগারে কাটাতে হয় তাকে।
জামিনে মুক্তি পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন, আর গ্রামে ফিরবেন না। নতুন করে জীবন গড়ার আশায় নিজ জেলা চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যান পার্বত্য জেলা বান্দরবানে। বান্দরবান সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। মামলার খড়গ তার পিছু ছাড়েনি। টানা ছয় মাস বাড়ি না গিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট রাতে বাড়ি থেকে বান্দরবান যাওয়ার পথে গ্রামের বাজার থেকে তাকে আবারো গ্রেফতার করা হয়।
সে বার জামিন পেয়ে আর গ্রামের পথ মাড়াননি। কিন্তু তার ঠিকানা জেনে যাওয়ায় বান্দরবান থানায়ও তার নামে নতুন মামলা হয়। ক্রমাগত হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বড় অঙ্কের টাকা ঋণ করে পাড়ি জমান সৌদি আরবে।
কিন্তু নিয়তির পরিহাস, ঋণের বোঝা পরিশোধ হওয়ার আগেই বিশ্বজুড়ে হানা দেয় করোনা মহামারী। প্রায় দেড় থেকে দুই বছর বেকার জীবন কাটাতে হয় প্রবাসে। একদিকে রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের কারণে শরীর ভারী কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছিল, অন্য দিকে বাড়ছিল ঋণের বোঝা। এই মানসিক চাপ আর দুশ্চিন্তা তার শরীর আর নিতে পারেনি। প্রবাসেই তিনি ‘হার্ট অ্যাটাকে’ আক্রান্ত হন। হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসায় তার হার্টে একটি রিং পরানো হয়। এর মাত্র পাঁচ মাস পর আবারো হার্ট অ্যাটাক হলে আরেকটি রিং পরাতে হয়।
দুটি রিং পরা শরীর নিয়ে ভারী কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় বিষণœ মনে দেশে ফিরে আসেন ওমর ফারুক জাভেদ। কিন্তু নিজের বাড়িতে এক দিনের জন্যও শান্তিতে থাকার সুযোগ পাননি। নামমাত্র বেতনে কক্সবাজারে একটি চাকরি করে কোনোমতে দিন কাটাতেন। ২০২৩ সালের ২৩ জুন, তার বড় চাচার জানাজায় অংশ নিতে গ্রামে এসে রাতেই ফিরে যাওয়ার পথে আবারো পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি।
সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেলেও তার জীবনের ক্ষতগুলো শুকায়নি। অনার্স সম্পন্ন না হওয়ায় ভালো কোনো চাকরি মেলেনি। জীবন-জীবিকার আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে এক বন্ধুর কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার করে একটি চায়ের টং দোকান নিয়ে বসেছেন তিনি, হালাল রিজিকের সন্ধানে। আপাতত চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার চট্টেশ্বরী রোডে আব্দুস সবুর ছাত্রাবাসের সামনে তার এই ছোট জগৎ।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির আনোয়ারুল আলম চৌধুরী বলেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে, পতিত আওয়ামী সরকার কিভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে ইসলামী ভাবধারার তরুণদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে দিয়েছে। হাজার হাজার যুবককে গায়েবি মামলা দিয়ে কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের পরিবারকে পথে বসানো হয়েছে।
লোহাগাড়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা আ ন ম নোমান বলেন, এই যুবককে শুধু তার ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শিক পটভূমির কারণে টার্গেট করা হয়েছে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ইশারায় পুলিশ কর্তৃক তাকে বারবার গ্রেফতার, বানোয়াট মামলায় জড়ানো, রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন এবং তার শিক্ষাজীবনকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই নিপীড়ন তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল, তার স্বাস্থ্যকে কেড়ে নিয়েছে এবং দুটি হার্ট অ্যাটাকের মাধ্যমে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
জাভেদের ছাত্রজীবনের দায়িত্বশীল বর্তমানে ন্যাশনাল ইংলিশ স্কুল চিটাগাংয়ের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আদিল নয়া দিগন্তকে বলেন, একজন মেধাবী অনার্স পড়ুয়া যুবকের করুণ কাহিনী আমাদের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে। যিনি আলেম হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তাকে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে জীবন ধারণের জন্য চায়ের দোকান চালাতে হচ্ছে। এটি নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে হাজারো নিরপরাধ তরুণের জীবন ধ্বংস করে দেয়ার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।



