শিক্ষক আন্দোলনে স্থবির ক্লাসের পাঠদান কার্যক্রম

পরীক্ষা সামনে অভিভাবকদের উদ্বেগ

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

কড়া নাড়ছে বার্ষিক পরীক্ষা। অথচ শিক্ষকদের আন্দোলনে স্থবির শ্রেণিকক্ষের পাঠদান কার্যক্রম। এ অবস্থায় উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। সারা বছর পড়াশোনার পর ঠিক বার্ষিক পরীক্ষার আগে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষকরা ক্লাসরুমের বাইরে থাকায় শিশুদের আশানুরূপ ফলাফল নিয়েও অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বিশেষ করে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের মতো কর্মসূচির কারণে অধিকাংশ স্কুলে ক্লাসই বন্ধ রয়েছে। অনেক প্রাইমারি স্কুলে অঘোষিত ছুটির আমেজ বিরাজ করছে। আবার ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা তাদের দাবি আদায়ে উপদেষ্টা বরাবরে গতকাল স্মারকলিপি দিয়েছেন। অন্য দিকে এমপিওভুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা শতভাগ উৎসব বোনাসের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শতভাগ উৎসব ভাতাসহ ৮ দফা দাবি জানিয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে বাংলাদেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্মচারী জাতীয় ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আযোজিত সংবাদ সম্মেলনে এই ৮ দাবি তুলে ধরা হয়।

বাংলাদেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্মচারী জাতীয় ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মো: আজিজুল হক রাজার সভাপতিত্বে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সদস্য সচিব মো: হাবিবুর রহমান (আদনান হাবীব)। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, উৎসব ভাতার দাবিতে কর্মচারীদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফলে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, হঠাৎ গত ঈদের আগে সরকার শুধু শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা বৃদ্ধি করে উৎসব ভাতা প্রদান করলেও কর্মচারীদের কোনো উৎসব ভাতা বৃদ্ধি করে নাই। ফলে সারা দেশে কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা যা কর্মচারীদের বাদ রেখে শুধু শিক্ষকদের উৎসব ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং আগামী ঈদের আগেই কর্মচারীদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাই।

কর্মচারীদের ৮ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে আসন্ন ঈদের আগেই কর্মচারীদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদান করতে হবে। গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটিতে কর্মচারীদের একজন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের মতো পূর্ণাঙ্গ পেনশন প্রদান করতে হবে। কর্মচারীদের সার্বজনীন বদলির ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রতি প্রতিষ্ঠানে দু’জন নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিতে হবে। কর্মচারীদের এক হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসাভাতাসহ শিক্ষাভাতা, টিফিনভাতা এবং সরকারি কর্মচারীদের মতো বাড়ি ভাড়া প্রদান করতে হবে। ল্যাব সহকারী কর্মচারীদের তৃতীয় শ্রেণী কর্মচারী হিসেবে পদায়ন করতে হবে এবং নন এমপিও কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করতে হবে। নবম পে-স্কেলে ১:৪ অনুপাত বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয় শ্রেণী কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন করে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ পদবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পদন্নোতি দিতে হবে।

অপর দিকে সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিও তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ ও অনুদানবিহীনগুলো এমপিওকরণের দাবি জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, গেজেট প্রকাশ ও এমপিওকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল এ স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে শিক্ষকরা উল্লেখ করেন, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো দীর্ঘ দিন যাবৎ অবহেলিত এবং সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই বঞ্চনা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গত ৮ সেপ্টেম্বর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন, স্বীকৃতি, পরিচালনা, জনবল কাঠামো এবং এমপিও-সংক্রান্ত নীতিমালা ২০২৫ গেজেট বা প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এই নীতিমালার আলোকে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন অনুদানভুক্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোকে প্রথম পর্যায়ে এমপিওভুক্ত করার জন্য গত ২৬ জুন গণবিজ্ঞপ্তির আলোকে ৩ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয়। এরপর গত ২ জুলাই কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের এমপিও শাখা থেকে একটি নোটিশের মাধ্যমে ৩ নম্বর কলামে বলা হয় যে, অনুদানভুক্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোর এমপিওভুক্ত করণের কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ করা হবে। এ পদ্ধতিতে নীতিমালা ২০২৫ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রস্তুত করা হবে।

উল্লেখ্য যে, সব প্রক্রিয়া নির্দেশনা মোতাবেক ২০২৫ নীতিমালা অনুসারে প্রস্তুত করা হলেও গত ৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেন যে, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন, স্বীকৃতি, পরিচালনা, জনবল কাঠামো এবং বেতন-ভাতা-অনুদান সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৮ এর সব শর্ত পূরণ করে, তাদের এমপিও করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের বিস্তারিত প্রতিবেদন গ্রহণ করতে হবে। যা অত্যন্ত হতাশাজনক এবং সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এই বিষয়টি বিবেচনা করে দ্রুতগতিতে ২০২৫ নীতিমালা অনুযায়ী যাচাই-বাছাইকৃত এক হাজার ৮৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিও তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ এবং অনুদানবিহীন সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিওকরণের জন্য আবেদনের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্মারকলিপিতে শিক্ষকরা বলেন, গত ১৩ অক্টোবর থেকে আজ পর্যন্ত মোট ২৮ দিন অবস্থান ধর্মঘটসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি এবং সেই সাথে ১০ নভেম্বর বেরা ২টা থেকে অনশন ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

এ দিকে দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি আদায়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি দ্বিতীয় দিনেও অব্যাহত রেখেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। একই সাথে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচিও চলছে। গতকাল সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শিক্ষকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, আমরা সরকারের আশ্বাস শুনেছি, তবে লিখিত বা দৃশ্যমান কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। তাই দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে, অবস্থান কর্মসূচিও অব্যাহত থাকবে। এর আগে গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে ‘কলম বিসর্জন’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গেলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বহু শিক্ষক আহত হন। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়লে শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার এলাকায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই শুরু হয় টানা অবস্থান ও কর্মবিরতি কর্মসূচি। শিক্ষকদের তিন দফা দাবি হলো সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডে বেতন প্রদান, উচ্চতর গ্রেডের জটিলতার স্থায়ী সমাধান, সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির নিশ্চয়তা।