মিরসরাইয়ে রাত নামলেই ডাকাত আতঙ্ক : চুরি ছিনতাই দিনদুপুরেও

এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
Printed Edition

চট্টগ্রামের মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানা এলাকায় রাত নামলে আতঙ্কে থাকেন মানুষ। অনেক স্থানে ডাকাতির ভয়ে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন এলাকাবাসী। গত কয়েক মাসে একের পর এক চুরি, ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় ধরনের অভিযান চোখে পড়েনি।

জানা গেছে, উপজেলায় গত ৪ মাসে ১২টি ডাকাতি ও ৩০টিরও বেশি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতদল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাতের আঁধারে কোথাও না কোথাও হানা দিয়ে চলছে। ডাকাতির শিকার বেশির ভাগই প্রবাসী পরিবার। একের পর এক এমন ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার প্রায় ৬ লক্ষাধিক মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় ব্যাপকহারে বেড়েছে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। কখনো কখনো দিনের বেলায়ও চুরির ঘটনার খবর পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে অপরাধের এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। কোনোভাবেই চুরি, ডাকাতি থামানো যাচ্ছে না।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে উপজেলার খইয়াছড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব খইয়াছড়া গ্রামের ভেন্ডরপাড়া এলাকার কলিমুল্লাহ ভেন্ডর বাড়ি মোহাম্মদ হানিফের ঘরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতদল দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে পরিবারের সদস্যকে জিম্মি করে। ঘরের কর্তা হানিফকে গামছা দিয়ে হাত-মুখ ও চোখ বেঁধে রাখে। এরপর তাদের বেঁধে মুঠোফোন, নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করেছে।

এ ছাড়া বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জিয়া উদ্দিন সিআইপির নির্মাণাধীন বাড়ির গোডাউনের তালা ভেঙে আড়াই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে।

এ দিকে মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ বাজারে বাজারে, গ্রামে গ্রামে চুরি, ডাকাতি বন্ধে জনসচেতনতামূলক সভাও করেছেন তাতেও সুফল মিলছে না। কিছু কিছু গ্রামে গ্রামবাসী রাত জেগে পাহারা বসিয়েছেন, বিভিন্ন ইউনিয়নে সড়ক বাতি লাগানো হয়েছে স্থানীয় ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে।

উপজেলার হিঙ্গুলী, খৈয়াছড়া, ইছাখালী, জোরারগঞ্জ, দুর্গাপুর ইউনিয়ন, মিরসরাই সদর ও মিরসরাই পৌরসভায় বেশি চুরি, ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। চোর ও ডাকাতের দল বসতঘরে ডাকাতি, সিঁদেল চুরি, গরু চুরি, মসজিদের দানবক্স চুরি, দোকানপাটে চুরি, পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি, প্রাইভেটকারে করে গরু চুরি, মোটরসাইকেল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে বাধা দিলে আহত করছে ডাকাতদল। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এসব ঘটনায় গত ৪ মাসে জোরারগঞ্জ থানায় ৪টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার ও কিছু ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপর দিকে মিরসরাই থানায় মামলা হয়েছে একটি।

গত ২২ নভেম্বর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের হাজীশ^রাই গ্রামে প্রবাসী আবদুল মান্নানের বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে মান্নানের বাড়িতে আসা বেশির ভাগ অতিথি সন্ধ্যার পর বিদায় নিলেও কয়েকজন রাতে ছিলেন। পরিবার ও আত্মীয়স্বজন কয়েকরাত ঠিকমতো ঘুমাতে না পারায় ঘটনার রাতে সবাই ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েন। তবে পুরুষরা সামনের বাড়িতে ছিলেন। ঘরে মহিলারা অবস্থান করেন। এরই মধ্যেই মান্নানের দ্বিতল ঘরের সদর দরজার তালা ভেঙে ৮-১০ জনের সঙ্ঘবদ্ধ ডাকাতদল ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপর পরিবারের সদস্য ও অতিথিদের বেঁধে তাদের সাথে থাকা ১৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ঘরে থাকা এক লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

বসতঘরে চুরি, ডাকাতির পাশাপাশি বেড়েছে পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরিও। উপজেলায় এ পর্যন্ত তিনটি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে এবং কয়েকটি ট্রান্সফরমার চুরির চেষ্টা করে চোরের দল। এতে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, দুশ্চিন্তায় রয়েছেন গ্রাহকরা। সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর ভোরে জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মস্তাননগর শাহকালা (রহ:) মাজার সংলগ্ন শহিদ স’মিলে তিনটি ট্রান্সফরমার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে খুলে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনসাধারণের ধাওয়ায় পালিয়ে যায় চোরের দল।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর মিরসরাই জোনাল অফিসের ডিজিএম আদনান আহমেদ চৌধুরী বলেন, রাতের আঁধারে উপজেলা সদরের আমবাড়িয়া গ্রাম থেকে একটি এবং দুর্গাপুর ইউনিয়ন থেকে দুইটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। প্রতিটি ট্রান্সফরমারের মূল্য প্রায় ৬০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা।

গ্রামে একের পর এক চুরি, ডাকাতির ঘটনায় গ্রামের যুবসমাজের উদ্যোগে বিভিন্ন গ্রামে রাত জেগে পাহারা দেয়া হচ্ছে। তেমনই উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর ও মিঠানালা-মঘাদিয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মলিয়াইশ গ্রাম। প্রতি রাতে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে লাঠি হাতে পাহারায় বসেন যুবকরা। গ্রামটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যুবকরা অংশ নেন। মাঝে মধ্যে পুলিশের টহল দলের সদস্যরাও তাদের সাথে অংশ নিচ্ছেন।

এ দিকে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী, বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান গত ২০ নভেম্বর মিরসরাই থানা পুলিশের সাথে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান তিনি বলেন, পুলিশের যদি জনবল সঙ্কট থাকে পুলিশকে সহযোগিতার জন্য যদি জনবল লাগে প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের সংগঠনের ভাইয়েরা সহযোগিতা করতে রাজি আছে। আমরা বর্তমানে যেভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড চলছে এভাবে মিরসরাইয়ে আর কোনো অপরাধ দেখতে চাই না। পুলিশ অনেক কাজ করেছে তা সত্য কিন্তু ক্রমবর্ধমান যে চুরি, ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে এটা বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ তাদের নিতে হবে। প্রশাসন আন্তরিক হলে এসব বন্ধ করা সম্ভব। অন্য দিকে এ আসনে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী নুরুল আমিন চেয়ারম্যান বলেন, মিরসরাইয়ে প্রতিনিয়ত চুরি-ডাকাতি হচ্ছে। এখানকার জনগণ আতঙ্কে রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন। উনারা যদি মনে করেন তাহলে আমাদের নেতাকর্মীরা চুরি-ডাকাতি রোধে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম আবদুল হালিম বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতোমধ্যে টহল আরো বাড়িয়েছি। এলাকার মানুষকে আরো সচেতন করার চেষ্টা করতেছি। বিভিন্ন এলাকায় পাহারা চলছে। তিনি আরো বলেন, ডাকাত দল শহর থেকে এসে ডাকাতির পর আবার সরে পড়ে। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে চুরি, ডাকাতি ও মহাসড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুর রহমান মজুমদার বলেন, আমাদের আগে ৩-৪টি টিম ছিল বর্তমানে ১০টি টিম কাজ করছে। সরকারি দুইটি গাড়ির মধ্যে একটি নষ্ট সেটি মেরামতে উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা রাতে ঘুমাই না। সারা রাত কাজ করছি। কয়েকজন পুলিশ থানায় থাকে বাকিরা এলাকায় মানুষের জানমাল রক্ষায় নেমে পড়েন। ইতঃপূর্বে আমি পাড়া মহল্লায়, বাজারে বাজারে গিয়ে মানুষজনকে সচেতন করেছি, মতবিনিময় করেছি। আমাদের কিছু জনবল সঙ্কট রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা ২০ জন চেয়েছিলাম পাঁচজন পেয়েছি। আমরা কাজ করছি, আশা করছি ভালো কিছু হবে।