‘কত পথ পাড়ি দিলে একটি মানুষ... মানুষ বলে ডাকবে তাকে’। বব ডিলানের বিখ্যাত গানের একটি চরণ। এই একটি বাক্যের সাথে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের কোথায় যেন একটু মিল পাওয়া যায়। ঠিক কতবার ফাইনাল খেলার পর একটি দলকে চ্যাম্পিয়ন তকমা পেতে অপেক্ষা করতে হবে? ফাইনাল, সেমিফাইনাল আবার সেমিফাইনাল তো ফাইনাল এই চক্ততে বন্দী থাকা দলটার জন্য ক্রিকেট যেন এক নিষ্ঠুর, হৃদয়বিদারক খেলা। একবার, দু’বার কিংবা তিনবার নয় ক্রিকেটের দুঃখ হয়ে যাওয়া এই দল বারবার তীরে এসে তরী ডোবানোর করুণ ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। আইসিসির প্রতিটা টুর্নামেন্টে সেই চেনা গল্প, দুর্দান্ত শুরুর পর শিরোপার একেবারে কাছে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গের পুনরাবৃত্তি।
সদ্য সমাপ্ত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শিরোপার মঞ্চ থেকে খালি হাতে ফেরাটা এই দলের জন্য পুরনো অভিজ্ঞতা শুধু নতুনভাবেই স্বাদ পাওয়া। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। মার্টিন ক্রোয়ের নেতৃত্বে, দুর্দান্ত বোলিং আর ব্যাটিং পারফরম্যান্সে তারা ছুঁয়ে ফেলেছিল স্বপ্নের সেমিফাইনাল। কিন্তুসেই স্বপ্নটা ক্রমশ মেঘে ঢেকে যায় পাকিস্তানের কাছে হেরে। এরপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালও ছিল যেন পুনরাবৃত্তি। এতো গেল শেষ চারের লড়াইয়ে কথা। ফাইনাল হারের তীব্র যন্ত্রণার সাথে যে কিছুরই তুলনা হয় না।
২০০৯ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল। মহাদেশীয় প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে ২০০ রানের আগেই আটকাতে হবে। ৬ রানেই অসিদের ২ উইকেট তুলে নিয়ে দারুণ শুরুও পায় নিউজিল্যান্ড। তবে লড়াকু মানসিকতার অসিদের বিপক্ষে কি আর এই মামুলি সংগ্রহ দিয়ে জেতা যায়। শেন ওয়াটসনের হার না মারা সেঞ্চুরির সাথে ক্যামেরুন হোয়াইটের ফিফটিতে সেবার শিরোপা ছুঁয়ে দেখার আশা শেষ হয় নিউজিল্যান্ডের। ২০১৫ বিশ্বকাপ। ওই আসরে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বে অদম্য এক দল ছিল নিউজিল্যান্ড। ফাইনালের আগ পর্যন্ত কিউইরা সব প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছিল। তবে শেষের লড়াইটা যে এতটা একপেশে পরিণত হবে তা ক’জন ভেবেছিল। সেই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৭ উইকেটে হারে শিরোপার খুব কাছে গিয়েও নিউজিল্যান্ড ছুঁতে পারেনি সোনালী সেই ট্রফি। অসিদের বিপক্ষে হারের পর এবার অনেক পরিণত নিউজিল্যান্ড। অতীতের সব গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে মরিয়া দলটি। এবারও দোর্দন্ড প্রতাপে ফাইনালে চলে যায় উইলিয়ামসনরা। এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপে ইংলিশদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ওই ম্যাচে যা হলো তার দুঃস্মৃতি কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়াবে কিউইদের।
বিশ্বকাপের সংস্করণ এবার পরিবর্তন হলো, তবে নিউজিল্যান্ডের সেই কপাল পোড়া ভাগ্য আর পরিবর্তন হলো কই । এবারও সেই মহাদেশীয় প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাস্ত তারা। ২০২১ টি-২০ বিশ্বকাপে অসিদের বিপক্ষে ট্রফি খরা ঘোচানোর সেই ম্যাচে ৮ উইকেটে হারে দলটি।
শুধুই অভিশাপ, দুর্ভাগ্য নাকি সামর্থ্যরে ঘাটতি? এভাবে শেষ ধাপে গিয়ে একের পর এক খেই হারানোর করুণ নজির সৃষ্টি অভ্যাসে পরিণত করার কারণই বা কি? বিশ্বকাপ জেতার মতো ভারসাম্যপূর্ণ দল যে নিউজিল্যান্ডের নেই সেটাও তো না। তবে কি ঘাটতি ছিল মানসিক চাপ আর আত্মবিশ্বাসের অভাব নাকি প্রতিপক্ষকে ধ্বসিয়ে দেয়ার মতো খুনে মানসিকতার অভাব। শুরুতে বলা ডিলানের গানের পরের লাইনটা ছিল এমন, ‘এর জবাব শোনো বন্ধু হাওয়ায় আসে ভেসে’। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা থেকে সফলতা পাওয়ার উপায় কিন্তু হাওয়ায় ভেসে আসবে না! চ্যাম্পিয়ন তকমা পেতে করণীয় যে নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে তাদের। ব্যর্থতার এত এত গল্পের মধ্যেও কিন্তু একবার শিরোপার দেখা পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড। যেই ভারতের বিপক্ষে এবার ফাইনাল হারতে হয়েছে সেই দলকে হতাশা উপহার দিয়েই ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দ্বিতীয় আসরের জয়ী দল তারা।



