আওয়ামী বিজ্ঞানীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন

কৃষি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কমবেশি পরিবর্তন আসলেও হাসিনা আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত একজনকেও সরানো হয়নি

যাত্রার পর থেকেই কেজিএফ হয়ে ওঠে অবসরে যাওয়া আওয়ামী কৃষি কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র।

কাওসার আজম
Printed Edition
কৃষি গবেষণা ফাইন্ডেশনের লোগো
কৃষি গবেষণা ফাইন্ডেশনের লোগো |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে কৃষি খাতকে দলীয়করণের শীর্ষে পৌঁছানো হয়। কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অধিভুক্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। স্বৈরাচার সরকারের শেষের দিকে দলীয়করণের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের সুবিধাভোগী শীর্ষ কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর তাদের পুনর্বাসন করে আওয়ামী সরকার। এই দুটি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হয়ে ওঠে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন। কৃষি খাতের মানুষ যাকে ‘কেজিএফ’ নামেই চেনেন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। বিগত প্রায় সাড়ে ৮ মাস ধরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। কৃষি খাতের বিভিন্ন সংস্থায় কমবেশি পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একেবারেই ব্যতিক্রম এই কেজিএফ। স্বৈরাচারের দোসরদের দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু যে, কেজিএফে চাকরিজীবীদের মধ্যেই দোসর রয়েছেন তা নয়। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) ভিসি পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় অধ্যাপক ড. শাহিদুর রশিদ ভূঁইয়াকে। কিন্তু কেজিএফের ৯ সদস্যের জেনারেল বডিতে এখনো তিনি বহাল রয়েছেন।

জানা যায়, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু হয় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন-কেজিএফের। রাজধানীর ফার্মগেটের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) ভেতর প্রতিষ্ঠানটির অফিস। তবে যাত্রার পর থেকেই কেজিএফ হয়ে ওঠে অবসরে যাওয়া আওয়ামী কৃষি কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। ফাউন্ডেশনের জনবল নীতিমালা অনুযায়ী, কিছু ছোট পদ ছাড়া প্রায় সব পদেই ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সিস্টেমভুক্ত (নার্সভুক্ত) প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরা কেজিএফে চাকরির সুযোগ পান। কৃষিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা ও প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণে অর্থ সহায়তা দেয় কেজিএফ। ফাউন্ডেশনটি পরিচালিত হয় ১৫ সদস্যের সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে। এর মধ্যে থেকে নির্বাচিত সাতজনকে নিয়ে গঠন হয় কেজিএফ বোর্ড বা পরিচালনা পরিষদ।

বেছে বেছে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের নিয়োগ

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার। অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে দলীয় বিবেচনায় চতুর্থ গ্রেডে থাকা ওই কর্মকর্তাকে তখন ডিজি করা হয়। এর আগে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ঘাস প্রকল্পের পিডি। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তখন নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও ওঠে। অবসরে যাওয়ার পর ২০২১ সালের নভেম্বরে তাকেই আবার কেজিএফের পরিচালক (প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সুপারিশে বিনা প্রতিযোগিতায় ড. নাথুরাম সরকার নিয়োগ পান বলে জানা যায়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আবার নির্বাহী পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটলেও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি।

কেজিএফের পরিচালক (শস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ) হিসেবে ২০২১ সালের নভেম্বরে নিয়োগ পান ড. মো: আককাছ আলী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) সাবেক এই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তিনি। জানা যায়, জনবল নীতিমালা ২০২০-এর অধীনে নিয়োগ পেলেও নিয়ম অনুযায়ী তার আবেদন করারই যোগ্যতাই ছিল না।

সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সুপারিশে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে ২০১৭ সালে নিয়োগ পান বেগম নাসরিন আক্তার। এখন তিনি সিনিয়র স্পেশালিস্ট (ডকুমেন্টেশন, পাবলিকেশন ও যোগাযোগ) হিসেবে কর্মরত। নাসরিন আক্তার নিউপোর্ট ইউনিভার্সিটি সিইডি, রিগায় পিএইচডির ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন বলে জীবনবৃত্তান্তে উল্লেখ করেন। দ্রুত সনদ জমা দেবেন অঙ্গীকার করে সাত বছরেও তা দিতে পারেননি। এ ছাড়া ড. রাজ্জাকের আত্মীয় মুহাম্মদ আব্দুর রহমান সিদ্দীক চুক্তিভিত্তিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে নিয়োগ পেয়ে এখনো বহাল আছেন বলে জানা যায়।

বারির সাবেক মহাপরিচালক ড. মো: নাজিরুল ইসলাম। ২০২২ সালের জুলাইয়ে সিনিয়র স্পেশালিস্ট (উদ্যানতত্ত্ব) পদে নিয়োগ পান। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. মো: খলিলুর রহমান। অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সিনিয়র স্পেশালিস্ট (মৎস্যসম্পদ ও জলজসম্পদ) পদে নিয়োগ পান।

বিগত স্বৈরাচার আমলে কেজিএফের সিনিয়র স্পেশালিস্ট হিসেবে নিয়োগ পান বিএলআরআইয়ের সাকে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: এরশাদুজ্জামান। টেকনিক্যাল স্পোশালিস্ট পদে নিয়োগ পান ড. শাহরিনা আখতার।

২০২১ সালের নভেম্বরে সিনিয়র স্পেশালিস্ট পদে (জলবায়ু ও প্রাকৃতিক সম্পদ) চাকরি নেন বিএআরসির সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: মনোয়ার করিম খান। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু কৃষি পরিষদের সনদ দেখিয়ে চাকরি নেয়া অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা এখন বঞ্চনার আওয়াজ তুলছেন।

শুধু শীর্ষ এসব কর্মকর্তাই নন, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনে (কেজিএফ) নিয়োগ পাওয়া পিয়ন-ড্রাইভার থেকে শুরু করে বেশির ভাগই দলীয় বিবেচনায়। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রভাবে, কেউ সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও মতিয়া চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আবার কেউ আওয়ামী দুঃশাসনের শেষ কয়েক বছরের কৃষি খাতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ওয়াহিদা আক্তার (সাবেক কৃষি সচিব) ও ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার (বিএআরসির সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান) দম্পত্তির আশির্বাদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কেজিএফের এমএলএসএস (পিয়ন) হয়েও মাস শেষে বেতন পান অর্ধলাখ টাকা। গাড়িচালকও কম না মাইনে ৫৩ হাজার। অফিস সহকারী পান ৬৮ হাজার টাকা। ক্লিনারের বেতন ৪৫ হাজার টাকা। শুধু কর্মচারীরা যে এত সুবিধা নিচ্ছেন তা নয়। কেজিএফের শীর্ষ পদের (নির্বাহী পরিচালক) বেতন প্রায় চার লাখ টাকা, পরিচালকরা পাচ্ছেন প্রায় তিন লাখ আর সিনিয়র স্পেশালিস্টরা নেন আড়াই লাখ টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়ার ক্ষেত্রে যেন উদার কেজিএফ। প্রতিষ্ঠানটি চালাতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বেতনের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ফুরালেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে আশানরূপ ফল বা গবেষণা নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই দশক হতে চললেও কৃষি খাতে প্রতিষ্ঠানটির তেমন অবদান রাখতে পারছে না। তবে অনিয়ম, দুর্নীতি, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামীপন্থী একটি চক্র কেজিএফের অনুদান লুটপাট করে চলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শেষ আমলে কৃষি খাতে সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তার একজনের নাম ড. শেখ মুহাম্মদ বখতিয়ার। বিএআরসির সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান। তার স্ত্রী ওয়াহিদা আক্তার ছিলেন প্রভাবশালী কৃষিসচিব। ২০২২ সালে কেজিএফের বোর্ড ও জেনারেল বডির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি ‘১০০ কৃষি প্রযুক্তি অ্যাটলাস’ নামে একটি বই প্রকাশে কেজিএফ থেকে ৮৫ লাখ টাকা খরচ করেন। এই টাকার অধিকাংশই তসরুফ হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। পরে আরো চারটি পুস্তিকা কেজিএফের টাকায় প্রকাশ করেন বখতিয়ার। প্রতিটিতে খরচ হয় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে কেজিএফ থেকে নেন ১০ কোটি টাকা। বখতিয়ার তার আপন ভাগনি সারজানা রহমানকে চুক্তিভিত্তিক অ্যাসিস্ট্যান্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে চাকরিও দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেজিএফের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এক সময় প্রতিষ্ঠানটিতে কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু বিগত দুই বছর ধরে কেজিএফ যেন পঙ্গু হয়ে আছে।

লোভনীয় পদ নির্বাহী পরিচালক

সংশ্লিষ্টরা জানান, জন্মলগ্ন থেকেই নির্বাহী পরিচালক পদ নিয়ে ধুঁকছে কেজিএফ। এই চেয়ারে একবার বসলে যেন ছাড়ার নাম নেই কারো। বিগত ১৮ বছরে মাত্র তিনজন নিয়মিত নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ পান। এর মধ্যে ড. নুরুল আলমের পর ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ড. ওয়ায়েস কবীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে ড. জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস নির্বাহী পরিচালক হন। ২০২২ সালের জুনে তিনি অবসরে গেলেও দুই মাস পর আবার তাকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নির্বাহী পরিচালকের চেয়ারে বসানো হয়। ড. জীবনের বিদায়ের পর ওই পদে বসার খায়েশ ছিল সাবেক কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের স্বামী বিএআরসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. শেখ বখতিয়ারের। সচিবের ক্ষমতা দেখিয়ে কেজিএফের নির্বাহী পরিচালক পদে নতুন কাউকে নিয়োগ না দিয়ে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর ড. নাথুরাম সরকারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে বখতিয়ারের সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও আওয়ামীপন্থী নাথুরামই এখনো বহাল আছেন।

জানা যায়, পটপরিবর্তনের পর কেজিএফে পদপদবির কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে, আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া সুবিধাভোগীদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সুর পাল্টে বিএনপি হওয়ার দৌড়ে আছেন। তাদের কেউ আবার কেজিএফের নির্বাহী পরিচালকের পদটিতে যেতে মরিয়া। তাদেরই একজন ড. মো: মনোয়ার করিম খান। তবে কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. নাজমুন নাহার করিমও চাচ্ছেন অবসরে গিয়ে কেজিএফের শীর্ষ পদটিতে বসতে।

জানা যায়, কেজিএফ একটি বোর্ড দিয়ে পরিচালিত হয়। অর্থায়ন করা হয় বিকেজিইটি ট্রাস্টের মাধ্যমে। এই ট্রাস্টের প্রধান কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।