গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

নারী কমিশনের প্রস্তাবনা পাস হলে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে

“দেশের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটি বিশৃঙ্খলা আনতে সুপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের প্রস্তাব আনা হয়েছে।”

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
জাতীয় প্রেস ক্লাবে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা
জাতীয় প্রেস ক্লাবে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা |নয়া দিগন্ত

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তাতে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বলা হলেও মূলত এতে নারীকে আরো ছোট করা হয়েছে, অসম্মানিত করা হয়েছে। নারীদের পারিবারিক জীবনের পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন জীবনের দিকে আহ্বান করা হয়েছে। দেশের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটি বিশৃঙ্খলা আনতে সুপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের প্রস্তাব আনা হয়েছে। নারী কমিশনের এসব প্রস্তাবনা পাস হলে দেশের পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। নারী-পুরুষের সম্প্রীতি ধ্বংসকারী এ প্রস্তাবনা বাতিল এবং একই সাথে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী নারী কমিশনকেও বাতিল করে দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী নারীদের নিয়ে নতুন করে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।

গতকাল ওয়ান ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন-বিতর্ক ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত বৈঠকে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রবের সভাপতিত্বে এবং আয়োজক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও বাংলাদেশ ইসলামী ইউনিভার্সিটির (বিআইইউ) সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুল মান্নানের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন- জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আব্দুল হান্নান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো: ফখরুল ইসলাম, লে. কর্নেল (অব:) হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক ফ্যাকাল্টি মেম্বার অধ্যাপক ড. আব্দুস সামাদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সভানেত্রী ড. শামীমা তাসনীম, লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজের ইসলামিক স্টডিজ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সেক্রেটারি ড. ফেরদৌস আরা খানম, আইপাস বাংলাদেশের হেলথ সিস্টেমের সাবেক সিনিয়র অ্যাডভাইজার ডা: শামিলা নাহার, মানবাধিকার ও আইনি সুরক্ষাকেন্দ্রের (মাসুক) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সাবিকুন নাহার মুন্নি, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শাহীন আরা আনোয়ারী, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদারাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. খলিলুর রহমান মাদানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরিফুর রহমান অপু, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: শহিদুল ইসলাম, মাসজিদুল জুমা কমপ্লেক্সের খতিব আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, অ্যাভারেজ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল মাহসীনা মামতাজ মারিয়া, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম প্রমুখ। স্বাগত বক্তৃতা করেন সিটি ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় ও অর্থনীতি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জুলফিকার হাসান।

ড. হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নারী কমিশন একটা ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রে সরকার পা দিয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক বন্ধন ভাঙার মিশন হিসেবে কাজ করছে এই কমিশন। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতীশীল করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র নারী কমিশনের এই প্রতিবেদন। কমিশনের এই প্রতিবেদন অত্যন্ত নিম্নমানের ও কুরুচিপূর্ণ। এটির কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই কমিশন বাতিল করতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকার আর জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। প্রতিবেদনটি এনজিওদের বিকৃত চিন্তার প্রতিফলন। নারীদের বাজারের পণ্য বানানোর জন্য প্রমোটেট করা হচ্ছে। তাদের কর্মসংস্থানের কথা বলে পতিতাবৃত্তির দিকে সুকৌশলে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। নারীদের জন্য শুধু কর্মসংস্থান নয়, নিরাপদ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেন, কুরআনের আইনে হাত দেবেন না, তাহলে আপনাদেরকে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে হতে পারে।

সভাপতির বক্তৃতায় ড. আব্দুর রব বলেন, নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং নীতিবিরোধী ও জাতিবিনাশী প্রতিবেদন। এ কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। এতে দেশের সব মত-পথ, আদর্শ-বিশ্বাস, ধর্মীয় এবং নৃগোষ্ঠীর মানুষের চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেনি। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে পরিকল্পিতভাবে এসব প্রস্তাবনা আনা হয়েছে। মূলত তারা আমাদের পরিবার প্রথা ভেঙে দিতে চায়। অবিলম্বে এ প্রতিবেদন বাতিল এবং কমিশনও বাতিল করতে হবে।

ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, নারী কমিশনের প্রস্তাবনা ইসলামবিদ্বেষী। তারা পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে এ ধরনের কথা সামনে এনেছে। এসব প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে দেশে বৃদ্ধাশ্রম বেড়ে যাবে এমনকি বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। এই কমিশন বাতিল করে ইসলামী স্কলার ও অন্যান্য ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে।

প্রফেসর ড. শামীমা তাসনীম বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় বারবার সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এমন যে, যেকোনো মূল্যে তারা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়; কিন্তু সমান অধিকার দিলেই কি সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে? তিনি আরো বলেন, তারা বারবার সমান অধিকারের কথা বললেও আবার চাকরিসহ বিভিন্ন স্থানে নারীর জন্য কোটা রাখার কথা বলছে। এটা স্ববিরোধী। তিনি বলেন, দেশে একজন নারী কিভাবে অনেক পুরুষ ফ্যাসিস্টদের ছাড়িয়ে গেছেন তা আমরা দেখেছি। এ জন্য শুধু সমানাধিকার দিলেই হবে না। আমরা নারীদের ন্যায্য অধিকার চাই। কুরআনে নারীকে যে সম্মান দিয়েছে, সম্পত্তির যে বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে সেটিই সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত।

ড. ফেরদৌস আরা খানম বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন নারীদের সমান অধিকারের কথা বলতে গিয়ে নারীদের অপমান করেছে। নারীদের মর্যাদা আরো নষ্ট করেছে। তারা নারীকে একটি ঘৃণ্য পেশার সাথে যুক্ত করতে চায়। পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চায়। এ কমিশনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে দেশের পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আমরা এ প্রস্তাবনা বাতিল করার দাবি জানাই। একই সাথে ধর্মহীনদের প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে।

ডা: শাহীন আরা আনোয়ারী বলেন, নারী কমিশন পরিবারকে ভাঙতে চায়। তারা আমার স্বামী-ছেলেকে পতিতালয়ে পাঠাতে চায়। স্বামীরা যখন পতিতালয়ে যাবে তখন ঘরের স্ত্রীর স্বাস্থ্যের কী হবে? তিনি বলেন, নারী কমিশন নারী স্বাধীনতার নামে পরাধীন করতে চায়। এ কমিশন বেশির ভাগ নারীর প্রতিনিধিত্ব করে না। এ কমিশন বাতিল করে বেশির ভাগ নারীর প্রতিনিধি নিয়ে নতুন করে কমিশন গঠন করতে হবে।

অ্যাডভোকেট সাবিকুন নাহার মুন্নি বলেন, নারী কমিশন বারবার সমতার কথা বললেও তাদের প্রতিবেদনে সমতার লেশমাত্র নেই। এই প্রতিবেদনে ধর্মকে বৈষম্যের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ছোট করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনটি স্ববিরোধী ও বিতর্কিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীদের বীরত্বগাথা কথা পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার কথা বলা হলেও ২৪-এর জুলাই বিপ্লবে নারীদের বীরত্বগাথা পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। মনে হয় এনজিও কোনো প্রকল্পের ইংরেজি প্রতিবেদন থেকে অনুবাদ করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। নারী কমিশন দেশের প্রচলিত বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায় এবং বংশপরিচয় মুছে দিতে চায়। নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ বানানো এ ধরনের প্রস্তাবনা তৈরির সাহস তারা কিভাবে পেল তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। কমিশনের রিপোর্ট অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তাদেরও বাতিল করে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে।