আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পাহাড়কে অশান্ত করতে নানা চক্রান্ত করছে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফের একটি অংশ। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা দখলে নিয়ে সেখানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। এসব ক্ষেত্রে সরাসরি মদদ দিচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত।
নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইতোমধ্যে সীমান্ত পথে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে অস্ত্র গোলা-বারুদ এনে বিশাল মজুদ গড়েছে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আর এসব অস্ত্রভাণ্ডার নিরাপদ রাখতে তারা পাহাড়িদের আশ্রয়ে অবস্থান করছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ জন্য বিভিন্ন জায়গায় নানা অবান্তর অভিযোগ তুলে বিতর্কিত করতে চায় সেনাবাহিনীকে। ইতোমধ্যে সেনা ক্যাম্পের কাজে বাধা দেয়ার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে তারা। খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়েছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেসব এলাকায় অভিযান ও তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। তার অংশ হিসেবে গত ২৪ অক্টোবর বর্মাছড়িতে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপন করতে গেলে সন্ত্রাসীরা বাধা দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা সাধারণ পাহাড়িদেরকে ভুল বুঝিয়ে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয়। আর এ জন্য তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
গত কয়েক মাসে সেনাবাহিনী বর্মাছড়ি এলাকায় ৮টিরও বেশি বিশেষ অভিযান চালিয়েছে। তবে দুর্গম পাহাড়ি পথ ও যাতায়াতের সীমাবদ্ধতায় এসব অভিযানের স্থায়ী ফল মেলেনি। সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকলেও তা মূল কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, ফলে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো দুরূহ হয়ে পড়ে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ইউপিডিএফ অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পাহাড়কে অশান্ত করার ছক আঁকছে। পার্বত্য খাগড়াছড়িতে গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যায়। তাদের এই সশস্ত্র তৎপরতা দীর্ঘ দিন ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোকে আবার অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, ইউপিডিএফ আবারো পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা অস্ত্র মজুদ করছে। সেনাবাহিনীর টহল দল গেলে তাদের সামনে নারী-শিশুদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তবে সন্ত্রাসীরা যেন কোনোভাবে জনগণের নিরাপত্তা বিপন্ন না করতে পারে, সে জন্য সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরো বাড়ানো জরুরি বলে মনে করি।’
ধর্মীয় কার্ড খেলে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প তৈরিতে বাধা পাহাড়ের শান্তি নিশ্চিত করতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে সেনাবাহিনী। কিছু অসঙ্গতি দেখার পর গত কয়েকদিন আগে বর্মাছড়ি এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প করতে যায় সেনাবাহিনীর একটি দল। এ সময় ওই জায়গায় বৌদ্ধ ধর্মের উপসনালয় আছে এবং সেখানে আর্মি ক্যাম্প করতে পারবে না বলে বাধা দেয় পাহাড়িরা। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘বিহারের জমিতে’ নতুন ক্যাম্প নির্মাণ করছে বলে ব্যাপক অপপ্রচার চালায় তারা। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এই জায়গাতে কখনোই কোনো বিহার ছিল না এবং এটি বিহারের জায়গা নয়। বরং ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয়দের উসকে দিয়ে একটি পক্ষ ফের বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, গত ২৪ অক্টোবর যৌথ বাহিনীর নতুন অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের জন্য বর্মাছড়িতে যাচ্ছে খবর ছড়িয়ে পড়তেই ইউপিডিএফ ফেসবুকে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। তারা সাধারণ জনগণকে ‘আর্য কল্যাণ বনবিহারের জায়গা দখল করা হচ্ছে’ বলে বিভ্রান্ত করে। অথচ পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, স্থানটি সরকারি খাসজমি এবং সেখানে আগে কোনো বনবিহার ছিল না। ইউপিডিএফ কৌশলে সাধারণ পাহাড়িদেরকে দিয়ে ধর্মীয় কার্ড খেলে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে চায় যাতে তাদের অস্ত্র ব্যবসা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত না হয়।
বিদেশে বসে অর্কিড চাকমার উসকানি : অর্কিড চাকমা নামে এক ব্যক্তি ভারতের মাটিতে বসে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদেরকে নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ২৪ অক্টোবরের ঘটনার আগের রাতে তিনি এলাকার যুবকদের বলেন, ‘তোমরা এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। ওরা যাতে কোনোভাবেই ক্যাম্প তৈরি করতে না পারে। তোমরা দাঁড়িয়ে গেলে ১০-১৫ জনের সেনাদল এমনিতেই নার্ভাস হয়ে যাবে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশের মাটিতে বসে দেশে উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে এখনই হার্ডালাইনে যেতে হবে সরকারকে। নইলে পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বিঘিœত হলে চরম মূল্য দিতে হতে পারে বাংলাদেশকে।
জেএসএসকেও বিবৃতি দেয়ার আহ্বান উষাতন চাকমার : ছাত্র-জনতা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি উষাতন চাকমা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্মাছড়ি ইউনিয়নে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানান। সম্প্রতি নিজের ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, আমি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে আহ্বান জানাচ্ছি- খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জমি বেদখল করে সেনা ক্যাম্প নির্মাণের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দেয়ার জন্য। শুধু উষাতন চাকমা নয়, এভাবে ফেসবুকে শতাধিক পোস্টে নানা মিথ্যা রটনা তৈরি করে স্থানীয়দের উসকে দেয়া হয়।
অন্য দিকে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সেখানে কোনো নতুন ক্যাম্প নির্মাণ হচ্ছে না, বরং নিরাপত্তা টহল ও পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবেই অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে।
বর্মাছড়িকে কেন বেছে নিলো ইউপিডিএফ : বর্মাছড়ি ইউনিয়নটি খাগড়াছড়ি সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। চারদিক ঘেরা ঘন বন। ইউনিয়নজুড়ে প্রায় ৯ হাজারের বেশি চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এখানে বাসিন্দাদের ৯৭ শতাংশই পাহাড়ি। শুধু বাজারে কিছু বাঙালি রয়েছে। আর এই দুর্গম এলাকাকেই নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছে ইউপিডিএফ। এখানে দীর্ঘ দিন ধরে তারা তাদের সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এলাকাটি রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর ও কাউখালী এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সাথে সংযুক্ত।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধ অস্ত্র এই এলাকায় প্রবেশ করে এবং বর্মাছড়িমুখ পাড়ায় মজুদ রাখা হয়। এখান থেকেই সেই অস্ত্র পার্বত্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সমতলের অপরাধীদের কাছে বিক্রি হয়। এসব অস্ত্র দিয়ে সংঘটিত হচ্ছে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও খুনের ঘটনা। সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি জনপদের সাধারণ মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে। পাহাড়ি এলাকায় সিভিল প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসন সেনাবাহিনী ছাড়া সেভাবে কাজ করতে পারে না। সেনাবাহিনী ছাড়া তাদের জন্য দুর্গম এলাকায় মুভমেন্ট অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাহাড়ে এখনই যৌথবাহিনীর তৎপরতা আরো বাড়ানো জরুরি। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়তে পারে সার্বভৌমত্ব। নিরাপত্তা ইস্যুতে অপ্রত্যাশিত বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ।



