বাংলাদেশ সংস্কার ও রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে মন্তব্য করে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টার সমর্থনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভূমিকা রাখতে হবে। আমি নিশ্চিয়তা দিচ্ছি যে, জাতীয় সংলাপে আস্থা, শান্তি ও ক্ষত পূরণে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তুত থাকবে। সবার জন্য একটি টেকসই ও বৈষম্যহীন ভবিষ্যৎ গঠনে জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের জনগণের অবিচল অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাবে।
গতকাল দিনব্যাপী ব্যস্ত কর্মসূচি শেষে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সব কথা বলেন। সকালে গুলশানে নতুন ‘জাতিসঙ্ঘ অভিন্ন প্রাঙ্গণ’ পরিদর্শনের মাধ্যমে তৃতীয় দিনের কর্মসূচি শুরু করেন অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এরপর তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সাথে মতবিনিময় করেন। একই স্থানে তিনি যুব সম্প্রদায় ও নাগরিক সমাজের সাথে বৈঠক করেন। সন্ধ্যায় তার সম্মানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া ইফতার ও নৈশভোজে যোগ দেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের অসাধারণ উদারতার প্রশংসা করে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলেন, সহিংসতা ও নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীরা বছরের পর বছর ধরে আশ্রয় দিয়ে আসছে। শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সংহতি ও মানবিক মর্যাদা প্রদর্শন করেছে। এ জন্য বাংলাদেশকে অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক মূল্য চুকাতে হয়েছে। বাংলাদেশের এই উদারতাকে বিশ্বকে মূল্যায়ন করতে হবে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো বেশি দায়িত্ব নিতে এবং শরণার্থী ও স্থানীয় অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সহায়তা হ্রাস করার ঘোষণায় আমরা এখন একটা গভীর মানবিক সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য রেশন ব্যাপকভাবে কমাতে হচ্ছে। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। মানুষ দুর্ভোগ পোহাবে, মারা যাবে। এই ট্র্যাজেডি এড়াতে সহায়তা দেয়ার জন্য আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোরালো আহ্বান জানাচ্ছি।
গুতেরেস বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধান ও তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছা ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা বাংলাদেশসহ অন্যান্য অংশীদারদের সাথে কাজ করতে পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা জানি যে মিয়ানমার পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে খারাপ হচ্ছে। রাখাইনসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বেসামরিক জনগণের হতাহতের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ও সীমান্তের বাইরে বাস্তুচ্যুতি বাড়াচ্ছে। তাই আমি মিয়ানমারের সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক জনগণের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের অবদানের কথা উল্লেখ করে গুতেরেজ বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের আন্তরিকতা ও ত্যাগের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তারা খুব কঠিন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করছে।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জটিল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রক্রিয়া ও দেশের প্রকৃত রূপান্তরের জটিলতা সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অবগত রয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে সংস্কার প্রক্রিয়াকে জাতিসঙ্ঘ পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। তিনি বলেন, মহাসচিব বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে অপপ্রচারের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তার এই সফর বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করা এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দেবার জন্য সহায়ক। সংস্কার প্রক্রিয়ার সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন ও বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী গণতন্ত্রে উত্তরণে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক : দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সাথে আলোচনায় বসেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহের, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামানকেও বৈঠকে দেখা গেছে।
বৈঠক সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। সংস্কারের কথা সবার আগে বলেছি। কিন্তু সংস্কারটা যত দ্রুত করা যায়, তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা বলেছি, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার দ্রুততার সাথে করে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংসদের মাধ্যমে সংস্কারের বাকি কাজগুলো করা হবে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেছেন কি না- জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, এ ব্যাপারে মহাসচিব কোনো মন্তব্য করেননি। কারণ এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মূলত এখানে সংস্কারের ব্যাপারে যেসব কমিশন করা হয়েছে সে সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে অবহিত করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও সেটা করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, আমরা সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে কথা বলেছি। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের সিদ্ধান্তে, আমাদের কাজে সহযোগিতা করবেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ই মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি রচনা করতে হবে। জুলাই সনদ সইয়ের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে। জনগণের কাছে আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা উল্লেখ করেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার টেকসই হয় না। এটা করতে হবে গণপরিষদের মাধ্যমে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ও ঐকমত্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনাকে সমুন্নত রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচনকে আমরা সংস্কারের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখি। সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন কাজে দেবে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এর সাথে একমত পোষণ করে। মতপার্থক্য হলো কোনো সংস্কার নির্বাচনের আগে হবে, আর কোনটা পরে হবে। আমরা মনে করি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে এই মতপার্থক্য কেটে যাবে এবং আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জুনায়েদ সাকি বলেন, জাতিসঙ্ঘ মনে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যথাসম্ভব ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেদেরই একটা জায়গায় পৌঁছাতে হবে।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, আমরা বলেছি, জাতিসঙ্ঘের তিনটা প্রতিষ্ঠানে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার তিনজন আত্মীয় কাজ করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় শেখ হাসিনার মেয়ে, ইউএনডিপিতে শেখ রেহানার ছেলে ববি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় ববির স্ত্রী কাজ করছেন। আমরা এই নিয়োগগুলো পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে।
সেনা প্রধানের সাক্ষাৎ : সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফেসবুক পেজে এ কথা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, সৌহার্দ্যপূর্ণ এ বৈঠকে পারস্পরিক কুশল বিনিময় হয়। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার প্রশংসা করেন। শান্তিরক্ষীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ঢাকায় জাতিসঙ্ঘ অভিন্ন প্রাঙ্গণ পরিদর্শন : সকালে রাজধানীর গুলশানে নতুন ‘জাতিসঙ্ঘ অভিন্ন প্রাঙ্গণ’ পরিদর্শনের মাধ্যমে তৃতীয় দিনের কর্মসূচি শুরু করেন অ্যান্তোনিও গুতেরেজ। এ সময় তিনি জাতিসঙ্ঘের পতাকা উত্তোলন করেন এবং বাংলাদেশ-জাতিসঙ্ঘ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় বক্তব্যে গুতেরেজ বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। সন্তোষ প্রকাশ করেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার প্রচেষ্টায়। তিনি বলেন, সঙ্কটময় এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে জাতিসঙ্ঘ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সহায়তায় আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব। পরে গুতেরেজ জাতিসঙ্ঘের বাংলাদেশ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। চার দিনের সফর শেষে গুতেরেজ আজ রোববার ঢাকা ছেড়ে যাবেন।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সাথে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের ও নাহিদ ইসলাম : নয়া দিগন্ত



