পুঁজিবাজারে হঠাৎ সূচক ও লেনদেনের উল্লম্ফন

মূল্যবৃদ্ধিতে দুর্বল কোম্পানির প্রাধান্য

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

পুঁজিবাজার আচরণে হঠাৎ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই গতকাল সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবসে বড় ধরনের উন্নতি ঘটেছে দেশের দুই পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেনে। সোমবার সকালে লেনদেনের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী হওয়া সূচকগুলো বড় কোনো বিক্রয়চাপের শিকার না হয়ে লেনদেনের শেষ সময় পর্যন্ত একই প্রবণতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। দিনশেষে দুই বাজারেই সব সূচকের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। একই সাথে বৃদ্ধি পায় বাজারগুলোর লেনদেনও।

এর আগে গত সপ্তাহের শুরু থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করে পুঁজিবাজার। সপ্তাহের প্রথম চারটি কর্মদিবসেই ইতিবাচক আচরণ ধরে রাখলে উল্লিখিত চারটি কর্মদিবসেই প্রধান পুুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকটি প্রায় ২০০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে এসে বাজারে সংশোধনের ঘটনা ঘটে। আগের সপ্তাহের একই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে নতুন সপ্তাহের প্রথম দিনটি শুরুতে বিক্রয়চাপের মুখে পড়লেও তা কাটিয়ে সূচকের ভালো উন্নতিতে দিন শেষ করে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে সূচকের উন্নতি দিয়েই লেনদেন শুরু করে বাজারগুলো। বড় কোনো বিক্রয়চাপের মুখে না পড়লে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ যেমন বৃদ্ধি পায় একই সাথে তা বাজার সূচকের ঊর্ধ্বমুখী এ প্রবণতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল ১০৯ দশমিক ১০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। আগের দিনের ৪ হাজার ৯১৫ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট থেকে দিন শুরু করা সূচকটি গতকাল দিনশেষে পৌঁছে যায় ৫ হাজার ২৪ দশমিক ৮৫ পয়েন্টে। আর এভাবে ১৩ কর্মদিবস পর ডিএসইর প্রধান সূচকটি আবার ৫ হাজার পয়েন্টের ঘর অতিক্রম করল। এর আগে সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর ৫ হাজার পয়েন্টের ওপরে ছিল সূচকটি। একই সময় বাজারটির দুই বিশেষায়িত সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ সূচকের উন্নতি ঘটে যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৯১ ও ২৪ দশমিক ৯২ পয়েন্ট।

অনুরূপভাবে দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক এদিন ২৬০ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। ১৩ হাজার ৬৮০ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট থেকে সকালে যাত্রা করা সূচকটি সোমবার দিনশেষে পৌঁছে যায় ১৩ হাজার ৯৩৭ দশমিক ২২ পয়েন্টে। এ সময় বাজারটির দুই বিশেষায়িত সূচক সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের উন্নতি ঘটে যথাক্রমে ১৬৩ দশমিক ৪৪ ও ১৪৮ দশমিক ৪২ পয়েন্ট।

সূচকের পাশাপাশি গতকাল বাজারগুলোতে লেনদেনেরও উন্নতি ঘটে। ঢাকা শেয়ারবাজার এদিন ৬৩৫ কোটি টাকার লেনদেন নিষ্পত্তি করে যা আগের দিন অপেক্ষা ২৫০ কোটি টাকা বেশি। রোববার ডিএসইর লেনদেন ছিল ৩৮৫ কোটি টাকা। আর এভাবে প্রায় দেড় মাসের মাথায় বাজারটির লেনদেন আবার ৬০০ কোটির ঘর অতিক্রম করল। গত ১৪ অক্টোবরের পর ডিএসইর লেনদেন আর এ পর্যায়ে পৌঁছেনি। চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে ১৫ কোটি টাকা থেকে ১৯ কোটিতে পৌঁছে লেনদেন।

এ দিকে পুঁজিবাজারের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। গতকাল ও এর আগের দিনের বাজার আচরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ দু’দিন লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানিগুলোরই প্রাধান্য ছিল। ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষ দশ কোম্পানির তালিকায় একমাত্র স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ছাড়া বাজারের মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির আর কোনোটিই জায়গা পায়নি। একই ভাবে এ দিন ৫ শতাংশের বেশি মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া ১৩৭ টি কোম্পানি ও ফান্ডের ৭০ শতাংশই ছিল ‘বি’ ও ‘জেড’ ক্যাটাগরির। বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই মনে করেন, বাজারের ভালো বা মন্দ সবসময়ই এটি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্বল্প সংখ্যক কারসাজিকারীদের দ্বারা। তাদের মতে, ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোনো কোনোটি লভ্যাংশ ঘোষণার রেকর্ড পরবর্তী মূল্যসমন্বয়ের ফলে ভালো মূল্যস্তরে রয়েছে। এ মুহূর্তে এগুলোই হওয়া উচিত বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু গত দু’দিনে এ ধরনের কোনো কোম্পানিই মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় দেখা যায়নি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আমাদের বাজার কোনো যুক্তি মানছে না। বারবার এত বিপর্যয়ের পরও বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা হচ্ছে না। বরাবরই তারা মৌলভিত্তির বাইরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বাজারকে অস্থির করে রাখতে চায়। গত দুই মাসের বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায় এ সময় বাজারে কোনো কোনো কোম্পানির দর বেড়েছিল ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ। এগুলোর কোনোটিই ভালো মৌলভিত্তির নয়। শুধু স্বল্প মূলধন তথা শেয়ারের স্বল্পতাকে পুঁজি করে কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ার এই হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। আর কিছু কিছু বিনিয়োগকারীর এ ধরনের আচরণের ফলে বাজারের শৃঙ্খলা যেমন নষ্ট হয় তেমনি প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা বাজারে টিকে পারে না। অথচ বিদ্যমান কোনো আইনের মাধ্যমে এ জাতীয় কারসাজি রোধ করাও সম্ভব হয় না। তাই প্রকৃত ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা একপর্যায়ে হতাশ হয়ে বাজার থেকে হাত গুটিয়ে নেন।

গতকাল ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষ কোম্পানি ছিল সিমটেক্সটাইলস। ২০ কোটি ২২ লাখ টাকায় ৬৬ লাখ ৯ হাজার শেয়ার হাতবদল হয় বস্ত্র খাতের কোম্পানিটির। ১৭ কোটি ৮ লাখ টাাকায় ৪ লাখ ৬১ হাজার শেয়ার বেচাকেনা করে শীর্ষ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল ওরিয়ন ইনফিউশন। ডিএসইর লেনদেনের শীর্ষ দশ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট, আনোয়ার গ্যালভেনাইজিং, রানার অটোমোবাইলস, আফতাব অটোমোবাইলস, মনোস্পুল পেপার, শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানি, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ও লাভেলো আইসক্রিম।

গতকাল ঢাকা শেয়ারবাজারে ৯২ শতাংশ কোম্পানি ও ফান্ডের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বাজারটিতে মোট লেনদেন হওয়া ৩৯১ কোম্পানি ও ফান্ডের মধ্যে ৩৫৯টি কোম্পানির দাম বাড়ে, ২২টির কমে এবং ১০টির দর ছিল অপরিবর্তিত।