সেনাপ্রধান মইনের সিদ্ধান্তহীনতা- নাকি পরিকল্পিত নীরবতা?

পিলখানায় সঙ্ঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক ঘটনা। এই হত্যাযজ্ঞে ৭৪ জন সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে প্রাণ হারান-যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা, গোয়েন্দা নজরদারি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ভয়াবহ দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে দেয়।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সঙ্ঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক ঘটনা। এই হত্যাযজ্ঞে ৭৪ জন সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে প্রাণ হারান-যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা, গোয়েন্দা নজরদারি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ভয়াবহ দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে দেয়। স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রাক্তন সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতার অপব্যবহারের কঠোর সমালোচনা করেছে।

এই প্রতিবেদনে কমিশনের সেই কঠোর পর্যবেক্ষণ, ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ এবং প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো অনুসন্ধানধর্মী দৃষ্টিতে তুলে ধরা হলো।

কমিশনের ভাষ্যমতে, হত্যা শুরুর পর সকাল ৯টা থেকেই পরিস্থিতির ভয়াবহতার তথ্য সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের কাছে পৌঁছায়। তৎক্ষণাৎ সেনা অভিযান শুরু করার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সময়ক্ষেপণ করেন এবং কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেননি। সেনাপ্রধান জেনারেল মঈনের বিষয়ে মূল অভিযোগ হলো : প্রথমত-তাৎক্ষণিক সেনা অভিযান বাধাগ্রস্ত করা, ৪৬ স্বতন্ত্র ব্রিগেড সকাল ১০:৪৫-এ পিলখানায় পৌঁছালেও ‘আক্রমণে নিষেধাজ্ঞা’র কারণে অভিযান শুরু করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত-অপারেশনাল কমান্ড সেন্টার থেকে বিছিন্ন থাকা-সবচেয়ে জরুরি মুহূর্তে তিনি সেনাসদরের বদলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অবস্থান করেন।

তৃতীয়ত- ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপের অদ্ভুত যুক্তি- তিনি কমিশনের কাছে দাবি করেন, ‘সেনা অভিযান হলে ভারতীয় বাহিনী ঢুকে পড়তে পারে’-যা কমিশনের মতে কোনো বাস্তব নিরাপত্তা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গঠিত নয়।

চতুর্থত-নিহত অফিসারদের মৃত্যুসংবাদ জেনেও নিষ্ক্রিয়তা: দুপুর নাগাদ ডিজি বিডিআরের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হন। কমিশন তার কর্মকাণ্ডকে ‘ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সমর্থন, সত্য গোপন, সেনাবাহিনীর মনোবলে আঘাত এবং অপরাধীদের পালানোর সুযোগ সৃষ্টি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কমিশন উল্লেখ করেছে- এ ছাড়া তার জন্য সম্ভাব্য প্রণোদনা হিসেবে ১/১১ সরকারের স্থপতি হওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিশোধের ভয়; রাষ্ট্রপতি হওয়ার লোভ এবং আবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভাইস অ্যাডমিরাল জহির ও এয়ার মার্শাল জিয়া : নিষ্ক্রিয় সমর্থকের তালিকায়

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধানদের বিষয়ে কমিশনের প্রধান অভিযোগ- সঙ্কট মুহূর্তে সামরিক অভিযান শুরুর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বা সেনাপ্রধানকে কোনোভাবেই রাজি করানোর চেষ্টা করেননি। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার আক্রান্ত হলেও প্রত্যাঘাতে উদ্যোগ নেননি (এয়ার মার্শাল জিয়ার ক্ষেত্রে)। এ ক্ষেত্রে ‘সক্রিয় ভূমিকাহীনতা’কে কমিশন জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি দায়িত্বহীনতা হিসেবে বর্ণনা করেছে।

লে. জেনারেল সিনা ইবনে জামালী : সঙ্কটের মুহূর্তে নেতৃত্বহীনতা

সেনাপ্রধানের অনুপস্থিতিতে অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব তার ওপর বর্তালেও- ৪৬ স্বতন্ত্র ব্রিগেডকে কোনোভাবেই সঠিক নির্দেশনা দেননি এবং সামরিক অভিযান চালাতে উদ্যোগ নেননি। কমিশন তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে- ‘তিনি কি পারেননি, নাকি করতে দেয়া হয়নি?’

জেনারেল আজিজ আহমেদ : ক্ষমতার অপব্যবহারের ধারাবাহিকতা

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় ও পরবর্তী সময়ে জেনারেল আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ডকে কমিশন অত্যন্ত গুরুতর অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো-বিডিআরে অবস্থানকালে স্ত্রীর মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, তাপস হত্যা মামলায় ফাঁসানো সেনা অফিসারদের অনিয়ম করে ডিজিএফআইয়ের কাছে হস্তান্তর, সেনাপ্রধান থাকাকালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষ অফিসারদের পদোন্নতি ও দক্ষ অফিসারদের চাকরিচ্যুতি- যা ‘সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা’।

লে. জেনারেল মইনুল ইসলাম : মানবাধিকার লঙ্ঘন ও তদন্ত ব্যর্থতা

ডিজিএফআইয়ের তত্ত্বাবধানে আটক বিডিআর সদস্যদের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং তাপস হত্যা চেষ্টা মামলায় অফিসারদের ‘ফাঁসানো’ নিয়ে তিনি অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ- পরিবারের সাথে যোগাযোগ ও আইনি সহায়তা বন্ধ রাখা এবং স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা।

লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী : ‘সামরিক নেতৃত্ব নাকি রাজনৈতিক আনুগত্য?’ কমিশন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে-ঘটনাস্থলে গিয়ে বিদ্রোহ দমনের বদলে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে দেখা করা; সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান। এটি সামরিক কমান্ড স্ট্রাকচারের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবের গভীরতা নির্দেশ করে।

মাঠপর্যায়ে ষড়যন্ত্রে জড়িত কর্মকর্তারা : নেপথ্যের সমন্বয়কারীরা

লে. কর্নেল শামসুল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ এসেছে- হত্যাকারীদের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া, হত্যাকাণ্ডের সময় কোর কন্ডাক্টর সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিকের বাসায় অবস্থান এবং ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষ যোগদান।

ব্রিগেডিয়ার ইমামুল হুদা, মাহমুদ হোসেন, মাহবুব সারোয়ারের বিষয়ে বলা হয়েছে- তাপস হত্যা চেষ্টা মামলায় সেনা অফিসারদের নির্যাতন, সাদা কাগজে সই নেয়া, আলামত বিকৃতকরণ এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ এসেছে। কমিশন এটিকে ‘ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক চক্রান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন শীর্ষ নেতৃত্ব : নজিরবিহীন ব্যর্থতা?

লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবরের বিষয়ে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো- বিদ্রোহের আগাম তথ্য না পাওয়া, ডিজি বিডিআরের মৃত্যুসংবাদ গোপন করা, পলায়নরত হত্যাকারীদের ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া, সেনা অভিযানে বাধা সৃষ্টি, তাপস হত্যা চেষ্টা মামলায় পাঁচজন সেনা অফিসারকে গুম ও ফাঁসানো ও গোয়েন্দা লিফলেট উদ্ধার না করা। একজন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে এসব ব্যর্থতা ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’- এমন ভাষায় কমিশন চিহ্নিত করেছে।

পিলখানার সেই দুই দিন : রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ ভাঙন উন্মোচিত

কমিশনের পর্যবেক্ষণ স্পষ্ট- বিডিআর হত্যাকাণ্ড কেবল একটি বিদ্রোহ ছিল না, বরং ছিল সামরিক নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তা, গোয়েন্দা ব্যর্থতা, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের জটিল সমন্বয়।

যে দিনগুলোতে-

* সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছিল নির্দেশের

* রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যস্ত ছিল ‘সমঝোতা’তে

* গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থতার ঘেরাটোপে

* এবং কিছু সামরিক কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে অথবা নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে হত্যাকারীদের সুবিধা করে দেন-

সেই দিনগুলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি নড়বড়ে করে দেয়। বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর বহুস্তরীয় ব্যর্থতার ফল। কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উঠে এসেছে- নির্দেশহীনতা, রাজনৈতিক প্রভাব, আনুগত্যের দ্বিধা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সমন্বয়ে ৭৪ জন কর্মকর্তা প্রাণ হারান।

রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষা একটাই- নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আবার ঘটতে পারে।