জাতীয় নির্বাচনে সর্বাধুনিক বডি ওর্ন ক্যামেরা (বডিক্যাম) ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ ও কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের দেহে এসব ক্যামেরা বসানো থাকবে। সারা দেশে ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রের জন্য এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বডিক্যাম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া এখনো খুব বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। চাওয়া হয়নি দরপত্র। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের আগে মানসম্পন্ন ও কার্যকর বডি ওর্ন ক্যামেরা সংগ্রহ করা যাবে কি না- তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিগগিরই সঠিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন (ফিচার) ক্যামেরা নির্বাচন করা না হলে, শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে নিম্নমানের যন্ত্র সরবরাহের আশঙ্কা তৈরি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
জানা গেছে, পুলিশের কাজে স্বচ্ছতা আনতে সর্বাধুনিক বডি ক্যামেরা সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই এই বডিক্যাম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এসব ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের বুকে এই যন্ত্র লাগানো থাকবে। এসব ক্যামেরায় ভিডিও, অডিও, অ্যালার্ম সিস্টেম থাকবে। এই ডিভাইসের মাধ্যমে ভিডিও ধারণের পাশাপাশি সরাসরি দেখারও ব্যবস্থা থাকবে। এর আগে ২০২১-২২ সালে পুলিশের জন্য প্রায় ১০ হাজার বডি ওর্ন ক্যামেরা কেনা হয়েছিল। তবে স্থানীয় সরবরাহকারীরা নিম্নমানের বডি ক্যামেরা গছিয়ে দেয়ায় তা কাজে আসেনি। এবার যেন বডিক্যামের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে সরকার সে ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে পুলিশের বডি ক্যামেরার মাধ্যমে পাওয়া ভিডিও ৩টি স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে পুলিশ ফোর্সের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে জেলায় সক্রিয় সবগুলো বডি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া পুলিশ সদর দফতর সারা দেশে বডিক্যাম কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। কোনো ভোটকেন্দ্র বা এলাকায় সমস্যা দেখা দিলে এই বডিক্যামের মাধ্যমে থানা, জেলা ও কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেন্টারে সঙ্কেত পাঠাবে। শুধু তাই নয়, বডি ক্যামেরার মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। এই প্রযুক্তির কারণে কেন্দ্রদখল, জাল ভোটসহ পেশিশক্তির মাধ্যমে ফলাফলে প্রভাবিত করার আশঙ্কা অনেকটা কমে যাবে।
তবে কাগজে-কলমে এতসব পরিকল্পনা করা হলেও সঠিক সময়ে মানসম্পন্ন বডি ক্যামেরা সংগ্রহ করা যাবে কি না- তা নিয়েই বেশ সংশয় তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিভাইস চূড়ান্ত না হওয়ায় বডি ক্যামেরা ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তিগত নানা দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বডি ক্যামেরা চূড়ান্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী বিষয়টি তদারকি করছেন। বডি ক্যামেরা সংগ্রহের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রাথমিক কমিটি গঠন করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ছাড়াও এই কমিটিতে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (ফাইন্যান্স), অতিরিক্ত আইজিপি (লজিস্টিকস অ্যান্ড অ্যাসেট একুইজিশন), অতিরিক্ত আইজিপিসহ (পুলিশ টেলিকম) কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি।
পুলিশ টেলিকম সূত্রে জানা গেছে অতীতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় বডি ক্যামেরা ক্রয় প্রক্রিয়ায় পুলিশ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট হতে চাইছে না।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে বডি ক্যামেরা সরবরাহের জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো স্মার্ট টেকনোলজিস (হুয়াওয়ে প্রতিনিধি), এমডিএম (মটোরোলার প্রতিনিধি), হিকভিশন, হাইটেরা এবং ডাহুয়া সিকিউরিটি। ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদাভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটির কাছে প্রস্তাবনা উপস্থাপন ও যন্ত্র প্রদর্শন করেছে। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের যোগশাজশে এমডিএম (মটোরোলার প্রতিনিধি) পুলিশের রেডিও ডিভাইস সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চক্র অতীতের মতো এবারো ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানটি সাবেক আইজিপি বেনজীরের আমলে পুলিশ টেলিকমের ৪২টি টেন্ডারের মধ্যে ৪১টির কাজ পেয়েছিল। ১৫ বছর আইটি সেক্টর লুটেপুটে সাবেক আমলের সিন্ডিকেটই খোলস পাল্টে ‘ম্যানেজ’ করে বডিক্যাম প্রদানের টেন্ডারের কাজ পেতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০২১ সালে কেনা বডিক্যামের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দাম পড়েছিল ৮০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা। দুর্নীতিবাজ চক্র আবারো সুযোগ পেলে মানহীন বডিক্যাম সরকারকে গছিয়ে দিতে পিছপা হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিবাজ ওই চক্রকে এখনই রুখতে হবে। তা না হলে আইসিটি খাতের সুশাসন নিশ্চিত হবে না।
এমডিএম প্রতিষ্ঠানের কর্নধার দেলোয়ার হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠান এই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করছে না। কারণ তাদের পণ্যের মূল্য বেশি রয়েছে। বেনজীর আহমেদের সময়ে ৪১টি কাজ পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা মিথ্যা কথা। এটা নিয়ে সে সময় অনেক ঝামেলা হয়েছে। অভিযোগটি সত্য নয়।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বডিক্যাম অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। তবে এটা করতে হলে দ্রুতই করা প্রয়োজন। কারণ শুধু ক্যামেরা লাগালেই তো হবে না। সেটা চালানো নিয়ে ট্রেনিংয়ের বিষয় রয়েছে।