- ৩৬ আসনের বাস বদলে যাচ্ছে ৪০-৪২ আসনে
- অ্যাম্বুলেন্স কেটে তৈরি হচ্ছে হিউম্যান হলার
সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এই দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী বাস ও ট্রাক। বাড়তি আয়ের জন্য মালিকরা বেআইনিভাবে যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাস ও ট্রাক অবৈধভাবে কাঠামো পরিবর্তন করে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঠামো পরিবর্তনকারী যানবাহন সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যানবাহন। তার পরও এসব যানবাহনকে মূল আকৃতিতে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই এসব কাঠামো পরিবর্তন করে সড়কে বাস-ট্রাক চালানো হচ্ছে। চেসিস পরিবর্তন করার বিষয়টি সরাসরি তদারকির এখতিয়ার বিআরটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু সরকারের এ সব কর্মকর্তার লোভের কারণেই এমনটা করার সুযোগ পাচ্ছেন মালিকরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, বাস, মিনিবাস এবং হিউম্যান হলারের সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৬৬৮টি। এর সব কটির সামনে-পেছনে লাগানো হয় অতিরিক্ত কাঠামো (বাম্পার)। আবার বডির দুই পাশে লাগানো হয় তিন কোণা বড় আকৃতির লোহার পাতের অ্যাঙ্গেল ও লোহার হুঁক। কিছু কিছু বাস-মিনিবাস লম্বা করে আসন বাড়ানো হয়েছে। বাম্পার লাগানো হয়েছে সব মিনিবাসে। এ ছাড়া ভেতরে মিনিবাসের ৩০ আসনের পরিবর্তে ৪০ থেকে ৪২ আসন করে বাসে রূপ দেয়া হচ্ছে।
একই সাথে অতিরিক্ত মাল বোঝাই করার জন্য ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সামনে ও পেছনে মিলিয়ে মূল কাঠামোর (বডি) চেয়ে সাত ফুট পর্যন্ত লম্বা করা হয়। আর চওড়ায় দুই ফুটের বেশি বাড়ানো হয়। বিশেষ করে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের চালকের কেবিনের চেয়ে মালামাল বহনের অংশ চওড়া করে ফেলা হয়। এরকম কাঠামো পরিবর্তন করে তিন গুণ পর্যন্ত বেশি মালামাল বহন করা হচ্ছে।
রাজধানীর স্বল্প দূরত্বের যানবাহন হিসেবে সর্বোচ্চ ঝুঁকি আর চরম ভোগান্তির অপর নাম লেগুনা পরিবহন বা হিউম্যান হলার। এসব লেগুনার বেশির ভাগই মূলত পুরনো অ্যাম্বুলেন্স এর বডি পরিবর্তন করে তৈরি হয়। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যাত্রীবাহী এই অবৈধ লেগুনা পরিবহন চলাচলে ডিএমপির পক্ষ থেকে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবে সেই নিষেধাজ্ঞা পালনে নেই প্রয়োজনীয় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।
মোটরযান আইন অনুসারে, যানবাহনের মূল কাঠামো বা আকৃতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন অবৈধ। পরিবর্তিত কাঠামো নিয়ে কোনো যানবাহনের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বিআরটিএ দীর্ঘদিন এসব যানের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ দিয়ে আসছে। গত কয়েক বছরে সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় সামনে আসে বাস-ট্রাকের কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়টি। এর পর বাস-ট্রাক মূল কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর ধর্মঘট আর চাপের কারণে কয়েক দফা অভিযান পরিচালনা করেও পিছিয়ে আসে সরকার। ফলে যানবাহনের আকার পরিবর্তনের বিষয়টি বহু দিন ধরে ঝুলে রয়েছে। আর এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনার হারও বাড়ছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে, ২০১৪ সাল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিগত এক যুগে দেশে ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত ও এক লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন আহত হয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতি শুধু গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করে এ তথ্য পেলেও দেশের হাসপাতালগুলোর চিত্র বলছে হতাহতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৬৮ দশমিক ৪১ শতাংশের পেছনে বাস ও ট্রাক জড়িত। দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশেরই উৎস বাস। আর ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্ঘটনায় যুক্ত ট্রাক।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ দশমিক ৫ শতাংশই মুখোমুখি সংঘর্ষ কিংবা পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার কারণে ঘটছে। আর একমাত্র কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে কাঠামোগত (আকৃতি) পরিবর্তন।
সূত্র জানায়, আমদানি করা ট্রাকগুলো লম্বায় ১৬ ও ২০ ফুট এবং টেইলর ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কিন্তু মালিকরা এসব ট্রাক লম্বায় দুই থেকে সাত ফুট পর্যন্ত এবং চওড়া দুই ফুট পর্যন্ত বাড়িয়ে থাকেন। বাসের ক্ষেত্রেও লম্বায় বাড়ানো হয়ে থাকে। আর এ সবই হচ্ছে নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ নামের বাস ও ট্রাকের বডি তৈরি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিস্ত্রি সবুজ মিয়া জানান, বাস-ট্রাকের বডি তৈরির ক্ষেত্রে মালিকরা যেভাবে বলেন সেভাবেই তাদের তৈরি করতে হয়। যে চেসিসে ৩৬ বা ৩৭ সিটের গাড়ি হয়, মালিকরা সেখানে ৪২ সিটের গাড়ি বানানোর জন্য বলছেন। ট্রাকের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত বড় বডি তৈরি করিয়ে নেন মালিকরা। নতুন অবস্থায় এসব যানবাহনে সমস্যা দেখা না দিলেও কিছু দিন পর ব্যালেন্সিং সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন এই মিস্ত্রি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আমরা দক্ষ চালক তৈরি করছি, নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছি এবং আইন প্রয়োগ করছি। একই সাথে চালকদেরও সচেতনতার সাথে গাড়ি চালাতে হবে, যেহেতু রাস্তায় গাড়ি অনেক বেশি।



